আজ মন খারাপের দিন

আজ মন খারাপের দিন

সোহেল মাহরুফ

বাস থেকে নামার পরেও নির্ঝরের মন খারাপ ব্যাপারটা সামাল দেয়া হয়ে ওঠে না। সে ফুটপাত ধরে মানুষের ভিড় ঠেলে এগোতে থাকে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড রোদের এই গরমে তেতে ওঠা ফুটপাতে মানুষের এত ভিড় হওয়ার কথা নয়। তবুও প্রচন্ড ভিড়। ঢাকা শহর বলেই কথা। এখানে সকাল দুপুর সন্ধ্যা নেই। সারাক্ষণই ভিড়। ব্যস্ত মানুষগুলো উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে। নির্ঝর হঠাৎ হাঁটা বন্ধ করে। ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ভিড়ের ধাক্কায় এক জায়গায় দাঁড়ানোর উপায় নেই। তাই ভিড় ঠেলে পাশে গিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। তবু তার মন খারাপ ভাব কমে না। বরং বেড়েই চলে। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে মন খারাপের অ্যানাটমি করতে শুরু করে। ভাবে, আসলে তো আজ তার মন খারাপ থাকার কথা ছিল না। বরং সকালে তার মনটা বেশ ফুরফুরেই ছিল। বিশেষ করে কাল রাতে সে ঝাক্কাস একখানা কবিতা লিখেছে। তাই সকালে কবিতাখানা পকেটে নিয়ে বের হতেই তার মনে হলো- ব্যাটা সাহিত্য সম্পাদক, এইবার কবিতা না ছাইপা যায় কই! কিন্তু পত্রিকা অফিসে ঢুকে সাহিত্য সম্পাদকের কুচকানো চেহারা দেখেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। তার ওপর আবার তার লেখা দেখে গোঁফনাড়ানো মন্তব্য শুনে মেজাজটা আরো বিগড়ে যায়। লেখাটা হাতে নিয়ে লেখার দিকে না তাকিয়েই তাকে আপাদমস্তক অবলোকন করে বলে ওঠলেন-এইগুলা কী লিখছেন? এত সকালেই নিজেরে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ মনে হয়। জবাবে নির্ঝর কিছু বলে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। 

তখন সে আবার বলতে শুরু করে- পোস্টমর্ডানিজম- আল্ট্রামর্ডানিজম বুঝেন?


সে না সূচক মাথা নাড়ে। তারপর শুরু হয় তার লেকচার। বর্তমানে ভালো লেখকের অভাব, বাংলাদেশে অধিক পত্রিকা থাকার উপকারিতা এবং অপকারিতা-এসব বিষয়ে আর কি। সেখানে আরেকজন প্রতিষ্ঠিত লেখকও বসেছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে ইনফরমেশন দিয়ে ছুটে যাওয়া অংশগুলো জোড়া দিচ্ছিলেন। আর নির্ঝর শুধু মাথা নিচু করে হু হা করছিল। কিছুক্ষণ পর বিজ্ঞ সাহিত্য সম্পাদক সাহেব বলে উঠলেন- হু হা করলে হবে না। পড়াশোনা করতে হবে। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। লেখালেখি সাধনার বিষয়। সাধনা- সাধনা করতে হবে। ঐ যে একটা গান আছে না ‘ সাধন বিনে...


কিন্তু তিনজনের কেউই আর গানের কথা মনে করতে পারে না। তাই সাহিত্য সম্পাদকের হেড়ে গলার সঙ্গীত চর্চা তেমন এগোয় না। বরং তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলেন- কাগজ কলম নাও। কিছু বইয়ের নাম বলছি। আজিজ মার্কেট থেকে কিনে নিয়ে পড়বা। প্রচুর পড়তে হইবো। লেখতে হইলে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নাই। কাগজ কলম নাও-বইয়ের নাম লেখো। তার কাছে কাগজ কলম নেই শুনে তিনি আর একবার খেঁকে উঠলেন। তারপর তিনি নিজের থেকেই কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে বইয়ের নাম বলতে শুরু করলেন। জটিল জটিল সব নাম। নির্ঝরের ভালো লাগে না। তাই সে কাগজটা হাঁটুর ওপর নিয়ে তাতে কিছু না লিখে শুধু আঁকিবুঁকি করে। মাঝে সাহিত্য সম্পাদকের উদ্দেশে দু’তিনটি অশ্রাব্য গালিগালাজও লিখে ফেলে। এ মুহূর্তে সেগুলো আবার  উচ্চারণ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু ফুটপাতের মানুষ তাকে পাগল ভাববে বলে মনে মনে সে গালিগুলো আবার উচ্চারণ করে।


সাহিত্য সম্পাদক সাহেব লেকচার দিয়ে যখন মোটামুটি ক্লান্ত তখন নির্ঝর আর কোন কথা খুঁজে পায় না। তিনজনই হঠাৎ নীরব হয়ে যায়। রুমের ভেতর অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। নির্ঝরই আবার নীরবতা ভাঙে। বলে- বস উঠি। দোয়া করবেন। ভবিষ্যতে যেন ভালো লিখতে পারি। তারপর সম্পাদককে আর কিছু  বলার সুযোগ না দিয়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। রুম থেকে বেরোতেই তার মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। ভাবে, এই লোকটার কথায় এতক্ষণ হু হা করার দরকার কী ছিল। শুধু শুধু সময় নষ্ট। সে যখন লেখা ছাপবে না তখন তার মুখের ওপর চলে আসলেই হত। তারপর রাস্তায় এসে উদ্দেশ্যহীনভাবে একটা বাসে উঠে পড়ে। শাহবাগ এসেই মনে হলো তার আর কোথাও যাওয়ার নেই। তাই এখানেই নেমে পড়ল। এ নিয়ে কন্ডাক্টরের সাথে কথা কাটাকাটি মন খারাপটা আরো বাড়িয়ে দেয়। এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ গিয়ে পড়ে জাদুঘরের গেটে টাঙানো ব্যানারের ওপর। “বনসাই প্রদর্শনী”। সে হঠাৎ ভাবে ভেতরে ঢুকে দেখা যাক। যদি বামুন গাছের দুঃখে মনের দুঃখ কিছুটা কমে। যেই ভাবা সেই কাজ।


সে জাতীয় জাদুঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঘুরতে ঘুরতে একটা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। টেবিলের উপরে সুদৃশ্য টবে ছোট ছোট গাছগুলো সাজানো। টেবিলের ওপাশেই এক জোড়া কপোত কপোতী। অদ্ভুত তাদের ম্যাচিং। ছেলেটা প্রায় ছ’ফুট তিন ইঞ্চি আর মেয়েটা পাঁচ ফুট কিংবা চার ফুট দশ ইঞ্চি। ঠিক যেন বটবৃক্ষের সাথে লাগানো বটের বনসাই। উপমাটা মনে পড়তেই তার হাসি পায়। এর মধ্যে কপোত কপোতী হঠাৎ ফিসফিসানি সুরটা বদলে বলে উঠে-দেখো ঐটা দেখতে খুব সুন্দর না। জবাবে কপোত বলে- হুঁ, ঠিক তোমার মতো। এটা শুনে নির্ঝরেরও বেশ হাসি পায়। ওদিকে মেয়েটা তখন রাগে অগ্নিশর্মা- কি বললে?

-না, মানে তুমি দেখতে ওর মতো।

-কি?

-বনসাই।

-কি বললে? আবার বল। 

-সরি। আর বলব না। 

-না, তোমাকে আবার বলতে হবে। নইলে এই টব তোমার মাথায় ভাঙবো। 

-সরি। বললাম তো আর বলব না। 

-কান ধরে বল যে আর বলবে না। 

এবার ছেলেটাকে বেশ অসহায় দেখায়। সে একবার চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে চোরের মতো কান ধরে বলে- আর বলব না। 

এই দৃশ্যটা নির্ঝরের ভালো লাগে না। এই অসহায় গাছের সাজানো প্রদর্শনীও তার আর ভালো লাগে না। সে দ্রæত বের হয়ে যায়। বাইরে বের হতেই কড়া রোদে তার মাথা চনচন করে উঠে। সেই সাথে পেটের ভেতর ক্ষুধাটা চনমন করে উঠে। হাতের দিকে তাকায় সময় দেখার জন্য। কিন্তু ঘড়িটা যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। তখনই মনে পড়ে সেটা কিছুদিন আগে পাশের রুমের ছেলেটার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে-মেসের খরচ মেটানোর জন্য। তখন পকেটে হাত দেয়। এখন বিলাসিতা বলতে শুধু এই চলমান কথা বলার যন্ত্রটাই আছে। কবি গুণ আদর করে এর নাম দিয়েছেন মুঠোফোন। কিন্তু এটা পোষা আর এক যন্ত্রণা। দু’দিন পর পরই তিনশ টাকা করে লোড করতে হয়। মাঝে মাঝে একদিনও যায় না। এটা এখন আসলেই তার জন্য যন্ত্রণা হয়ে গেছে। তবুও এটা বাদ দিয়ে সে জীবন ভাবতে পারছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই সে গেটের বাইরে চলে আসে। তার আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না। তাই যাত্রী ছাউনির বেঞ্চে বসে পড়ে। পেটের খিদে কিন্তু মোটেই কমেনি। সে মোবাইল বের করে সময় দেখে। দেখে দু’টা বেজে দশ। এ দেখে পেটের খিদে যেন আরো বেড়ে গেছে। পকেটে আবার হাত ঢোকায়। কিন্তু পাঁচ টাকার একটা ধাতব কয়েন ছাড়া আর কিছুই তার হাতে বাজে না। সে হিসাব মেলাতে পারে না। হঠাৎ মনে পড়ে গতকালই মোবাইলে দুইশো টাকার ফ্লেক্সি করেছে। তখন সব বিরক্তি গিয়ে পড়ে মোবাইলটার ওপর। মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় মোবাইলটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। বরং তার অন্য কথা মনে পড়ে। সেদিন একটা দোকানে দেখে এক লোকের জরুরি একশ টাকার দরকার। লোকটা দোকানদারের মোবাইলে একশ টাকার ট্রান্সফার দিয়ে ক্যাশ একশ টাকা নিল। নির্ঝরের আইডিয়াটা বেশ ভালোই লেগেছে। সে আশেপাশে সে রকমের কোনো দোকান খুঁজে পায় না। তাই ভাবতে থাকে কী করা যায়। এখন মেসে গেলেও পায়ে হেঁটে যেতে হবে। আর সেখানে গিয়েও কোনো লাভ নেই। কেননা মেসে দুপুরে রান্না হয় না। তাই অন্য উপায় না দেখে ভাবতে থাকে পাঁচ টাকা দিয়ে কী পাওয়া যায়। সামনে বাদামের গাড়ি দেখে কোনো কিছু না ভেবেই তিন টাকার বাদাম কিনে ফেলে। বসে বসে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে চিবোতে থাকে। আর ভাবতে থাকে কবি সুকান্তের কবিতার কথা- ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। এরিমধ্যে বেরসিক মোবাইলটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে বাল্যবন্ধু তামিমের নম্বর। সে বুঝতে পারে না কি এমন জরুরি দরকার যে এই ভরদুপুরে কল দিয়েছে। তাই কল রিসিভ করে না। বাজতে বাজতে কেটে যায়। আবার বেজে ওঠে। এবার অনিচ্ছাসত্তে¡ও রিসিভ করে। ওপাশ থেকে বেশ আপন করা কন্ঠে- হাই দোস্ত কি খবর? নির্ঝর হঠাৎ করে এমন আন্তরিকতার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। কেননা এর আগে সে নিজেই বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেকবারই পাশ কাটানো উত্তর পেয়েছে। একবার তামিমের অফিসেও গিয়েছিল লিটল ম্যাগের অ্যাডের জন্য। বিশাল অফিস তার-বিশাল কাজ কারবার। কিন্তু তামিম তো অ্যাড দেয়ই নি বরং মনে হয়েছে কিছুটা বিরক্তই হয়েছে। তারপর নির্ঝর আর যোগাযোগ করেনি-তামিমও না। তাই আজ তামিমের এই ফোন করার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। তাই সে নিরুত্তাপভাবেই উত্তর দেয়-এই তো ভালো। তোর কি খবর?

-আমাদের আর খবর দোস্ত। আছি ব্যস্ততার মধ্যে। তুই এখন কোথায়?

-আছি। ঢাকা শহরেই আছি।

-কোথায় আছিস্ বল্। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি তোকে নিয়ে আসার জন্য।

-মানে? হঠাৎ?

-দোস্ত, এই শহরে তুই আমার একমাত্র বাল্যকালের দোস্ত। অথচ তোর কোনো খোঁজ খবর রাখতে পারি না। কতদিন ধরে তোর সাথে দেখা হয় না। দোস্ত, আইজ তোরে খুব দেখতে ইচ্ছা করতাছে। 

নির্ঝর হঠাৎ উথলে ওঠা এমন বন্ধুত্বের দরদের মানে বুঝতে পারে না। তাই পাশ কাটিয়ে বলে-দোস্ত, আইজ মন খারাপ। অন্য একদিন আসব। কিন্তু তামিম নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই ছাড়বে না।

-কি কস্ দোস্ত-তোর মন খারাপ! কবির আবার মন খারাপ কিসের? কবিরা তো বারোমাস ফুরফুরে মেজাজে থাকে। আয় চইলা আয়। একসাথে আড্ডা দিলে তোর মন ভালো হইয়া যাইব। একথা শুনেই নির্ঝরের মন খারাপ ভাব অনেকটা কেটে যায়। তবু সে ভরসা পায় না। তাই বলে-বাদ দে দোস্ত। আরেকদিন আসবো। 

- না না দোস্ত তোরে আইজই আসতে হবে। তুই কোথায় বল্। আমার ড্রাইভার এখনই গিয়ে তোকে তুলে নিয়ে আসবে। তারপর দু’জন মিলে একসাথে গল্প করতে করতে লাঞ্চ সারব। 

-দোস্ত, লাঞ্চতো সেরে ফেলেছি।

-তাই। কোথায়? রাস্তার পাশের সস্তা হোটেলে?

- না দোস্ত, একদম ফুটপাতে। শুকনো বাদাম চিবুচ্ছি।

- আফসোস্। দোস্ত, তুই ছিলি আমাদের প্রাইমারি স্কুলের ফার্স্টবয়। অংক, ইংরেজিতে সব সময় একশ পাওয়া ছেলে আর তুই দোস্ত তিন বেলা ভাত খাইতে পাস্ না। আফসোস্। জানোস দোস্ত, তুই যেদিন তোর প্রথম কবিতাটা আমারে দেখাইলি সেদিন ভাবছিলাম তুই একদিন ঠিকই রবীন্দ্রনাথ, শেলি ওগো মতো কিছু একটা হবিই। আর আইজ তোরে ফুটপাতে বসে শুকনো বাদাম চিবুতে অয়। আফসোস্। দোস্ত তুই অক্ষন আমার অফিসে চইলা আয়। তোরে আইজকা ফাইভ স্টার হোটেল থেইকা আইন্যা লাঞ্চ করাবো। 

-দোস্ত আইজ না। অন্যদিন আসব। 

- না না আইজই আয়। তোর সাথে ইমপরটেন্ট কথা আছে।

-কি কথা মোবাইলে বল। 

- না না মোবাইলে কওয়া যাইব না। পারসোনাল কথা। 

-অসুবিধা নাই বল্। আমার আশেপাশে কেউ নেই। 

- না মানে কথা হইছে- কেমনে যে বলি।

-কি?

-না, মানে সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে থাকি তো। কেমন রোবট রোবট মনে হয়। মাঝে মাঝে একটু আনন্দ ফুর্তিরও তো দরকার আছে। কি কস্ দোস্ত, দরকার আছে না?

-তা তো অবশ্যই।

-তো হেভি একটা পিস্ জোগাড় করছি। অনেক কষ্টে ম্যানেজ করছি। 

-বুঝলাম না। পিস্ কি?

-তোরে কেমনে বুঝাই। পিস্ মানে আর কি- মোবাইলে পরিচয়। তো অনেক কষ্টে ম্যানেজ করছি। একদিন দু’জনে একটু নিরিবিলি সময় কাটাব আর কি? হোটেল টোটেলে তো বুঝস্ কত ঝামেলা। পুলিশ, সাংবাদিক কত ঝামেলা হইতে পারে। 

এসব শুনে নির্ঝর একটু শক্ত হয়ে যায়। বলে- তা আমি করব?

-না মানে বলছিলাম তোর রুমটা তো দুপুরের দিকে খালি থাকে। তো তোর রুমের চাবিটা যদি দিস্। বেশি সময় নেব না। জাস্ট ঘন্টাদুয়েক- তারপর চলে আসব। 

-সরি দোস্ত। তুই অন্যকিছু বল্। আমি আমার বেস্ট ট্রাই করব। কিন্তু এটা পারব না। 

-কেন পারবি না। তোর তো কোন সমস্যা নেই।

-না না, দোস্ত আমারে মাফ কর। আমি পারমু না। 

-ক্যান, তোর সমস্যা কি? দরকার হইলে তোর পুরা মাসের রুম ভাড়া আমি দিমু।

-মাফ চাই দোস্ত।

-আচ্ছা যা তোর প্রথম কবিতার বই বের করার সমস্ত খরচ আমি দিমু। 

-সরি দোস্ত।

-আচ্ছা, দরকার হইলে তোর জন্যও এরকম আরেকটা পিস্ জোগাড় কইরা দিমু। যা ইচ্ছা তাই করতে পারবি। 

-দোস্ত আমারে মাফ কইরা দেওয়া যায় না।

হঠাৎ তামিম চটে যায়- হালার ভীতু কোথাকার। এজন্যই তো কই তোর কবিতা কেউ ছাপে না ক্যান। ব্যাটা কবি কি এমনে এমনে অওন যায়। পিকাসো, বোঁদলেয়র, র‌্যাঁবো ওদের লাইফ দেখছোস্। ওগো বায়োগ্রাফি পড়ছোস্। জানোস্ কত অ্যাডভেঞ্চারাস ছিল ওগো জীবনযাপন। হালার মাইয়া কোথাকার। বলেই লাইনটা কেটে দেয়।


বাল্যবন্ধুর এমন গায়ে পড়ে দুর্ব্যবহার তার মনকে আরো খারাপ করে দেয়। তার এই মুহূর্তে এই শহরে একটুও ভালো লাগে না। মনে হয়, এ শহর তার জন্য নয়। তার ইচ্ছে করে গাঁয়ে ফিরে যেতে। সেখানে গিয়ে গাঁয়ের ধারে নদীর তীরে শেষ বিকেলের বাস থেকে নামার পরেও নির্ঝরের মন খারাপ ব্যাপারটা সামাল দেয়া হয়ে ওঠে না। সে ফুটপাত ধরে মানুষের ভিড় ঠেলে এগোতে থাকে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড রোদের এই গরমে তেতে ওঠা ফুটপাতে মানুষের এত ভিড় হওয়ার কথা নয়। তবুও প্রচন্ড ভিড়। ঢাকা শহর বলেই কথা। এখানে সকাল দুপুর সন্ধ্যা নেই। সারাক্ষণই ভিড়। ব্যস্ত মানুষগুলো উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলে। নির্ঝর হঠাৎ হাঁটা বন্ধ করে। ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ভিড়ের ধাক্কায় এক জায়গায় দাঁড়ানোর উপায় নেই। তাই ভিড় ঠেলে পাশে গিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। তবু তার মন খারাপ ভাব কমে না। বরং বেড়েই চলে। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে মন খারাপের অ্যানাটমি করতে শুরু করে। ভাবে, আসলে তো আজ তার মন খারাপ থাকার কথা ছিল না। বরং সকালে তার মনটা বেশ ফুরফুরেই ছিল। বিশেষ করে কাল রাতে সে ঝাক্কাস একখানা কবিতা লিখেছে। তাই সকালে কবিতাখানা পকেটে নিয়ে বের হতেই তার মনে হলো- ব্যাটা সাহিত্য সম্পাদক, এইবার কবিতা না ছাইপা যায় কই! কিন্তু পত্রিকা অফিসে ঢুকে সাহিত্য সম্পাদকের কুচকানো চেহারা দেখেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। তার ওপর আবার তার লেখা দেখে গোঁফনাড়ানো মন্তব্য শুনে মেজাজটা আরো বিগড়ে যায়। লেখাটা হাতে নিয়ে লেখার দিকে না তাকিয়েই তাকে আপাদমস্তক অবলোকন করে বলে ওঠলেন-এইগুলা কী লিখছেন? এত সকালেই নিজেরে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ মনে হয়। জবাবে নির্ঝর কিছু বলে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। 

তখন সে আবার বলতে শুরু করে- পোস্টমর্ডানিজম- আল্ট্রামর্ডানিজম বুঝেন?


সে না সূচক মাথা নাড়ে। তারপর শুরু হয় তার লেকচার। বর্তমানে ভালো লেখকের অভাব, বাংলাদেশে অধিক পত্রিকা থাকার উপকারিতা এবং অপকারিতা-এসব বিষয়ে আর কি। সেখানে আরেকজন প্রতিষ্ঠিত লেখকও বসেছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে ইনফরমেশন দিয়ে ছুটে যাওয়া অংশগুলো জোড়া দিচ্ছিলেন। আর নির্ঝর শুধু মাথা নিচু করে হু হা করছিল। কিছুক্ষণ পর বিজ্ঞ সাহিত্য সম্পাদক সাহেব বলে উঠলেন- হু হা করলে হবে না। পড়াশোনা করতে হবে। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। লেখালেখি সাধনার বিষয়। সাধনা- সাধনা করতে হবে। ঐ যে একটা গান আছে না ‘ সাধন বিনে...


কিন্তু তিনজনের কেউই আর গানের কথা মনে করতে পারে না। তাই সাহিত্য সম্পাদকের হেড়ে গলার সঙ্গীত চর্চা তেমন এগোয় না। বরং তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বলে উঠলেন- কাগজ কলম নাও। কিছু বইয়ের নাম বলছি। আজিজ মার্কেট থেকে কিনে নিয়ে পড়বা। প্রচুর পড়তে হইবো। লেখতে হইলে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নাই। কাগজ কলম নাও-বইয়ের নাম লেখো। তার কাছে কাগজ কলম নেই শুনে তিনি আর একবার খেঁকে উঠলেন। তারপর তিনি নিজের থেকেই কাগজ কলম এগিয়ে দিয়ে বইয়ের নাম বলতে শুরু করলেন। জটিল জটিল সব নাম। নির্ঝরের ভালো লাগে না। তাই সে কাগজটা হাঁটুর ওপর নিয়ে তাতে কিছু না লিখে শুধু আঁকিবুঁকি করে। মাঝে সাহিত্য সম্পাদকের উদ্দেশে দু’তিনটি অশ্রাব্য গালিগালাজও লিখে ফেলে। এ মুহূর্তে সেগুলো আবার  উচ্চারণ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু ফুটপাতের মানুষ তাকে পাগল ভাববে বলে মনে মনে সে গালিগুলো আবার উচ্চারণ করে।


সাহিত্য সম্পাদক সাহেব লেকচার দিয়ে যখন মোটামুটি ক্লান্ত তখন নির্ঝর আর কোন কথা খুঁজে পায় না। তিনজনই হঠাৎ নীরব হয়ে যায়। রুমের ভেতর অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। নির্ঝরই আবার নীরবতা ভাঙে। বলে- বস উঠি। দোয়া করবেন। ভবিষ্যতে যেন ভালো লিখতে পারি। তারপর সম্পাদককে আর কিছু  বলার সুযোগ না দিয়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। রুম থেকে বেরোতেই তার মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। ভাবে, এই লোকটার কথায় এতক্ষণ হু হা করার দরকার কী ছিল। শুধু শুধু সময় নষ্ট। সে যখন লেখা ছাপবে না তখন তার মুখের ওপর চলে আসলেই হত। তারপর রাস্তায় এসে উদ্দেশ্যহীনভাবে একটা বাসে উঠে পড়ে। শাহবাগ এসেই মনে হলো তার আর কোথাও যাওয়ার নেই। তাই এখানেই নেমে পড়ল। এ নিয়ে কন্ডাক্টরের সাথে কথা কাটাকাটি মন খারাপটা আরো বাড়িয়ে দেয়। এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ গিয়ে পড়ে জাদুঘরের গেটে টাঙানো ব্যানারের ওপর। “বনসাই প্রদর্শনী”। সে হঠাৎ ভাবে ভেতরে ঢুকে দেখা যাক। যদি বামুন গাছের দুঃখে মনের দুঃখ কিছুটা কমে। যেই ভাবা সেই কাজ।


সে জাতীয় জাদুঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ঘুরতে ঘুরতে একটা টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। টেবিলের উপরে সুদৃশ্য টবে ছোট ছোট গাছগুলো সাজানো। টেবিলের ওপাশেই এক জোড়া কপোত কপোতী। অদ্ভুত তাদের ম্যাচিং। ছেলেটা প্রায় ছ’ফুট তিন ইঞ্চি আর মেয়েটা পাঁচ ফুট কিংবা চার ফুট দশ ইঞ্চি। ঠিক যেন বটবৃক্ষের সাথে লাগানো বটের বনসাই। উপমাটা মনে পড়তেই তার হাসি পায়। এর মধ্যে কপোত কপোতী হঠাৎ ফিসফিসানি সুরটা বদলে বলে উঠে-দেখো ঐটা দেখতে খুব সুন্দর না। জবাবে কপোত বলে- হুঁ, ঠিক তোমার মতো। এটা শুনে নির্ঝরেরও বেশ হাসি পায়। ওদিকে মেয়েটা তখন রাগে অগ্নিশর্মা- কি বললে?

-না, মানে তুমি দেখতে ওর মতো।

-কি?

-বনসাই।

-কি বললে? আবার বল। 

-সরি। আর বলব না। 

-না, তোমাকে আবার বলতে হবে। নইলে এই টব তোমার মাথায় ভাঙবো। 

-সরি। বললাম তো আর বলব না। 

-কান ধরে বল যে আর বলবে না। 

এবার ছেলেটাকে বেশ অসহায় দেখায়। সে একবার চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে চোরের মতো কান ধরে বলে- আর বলব না। 

এই দৃশ্যটা নির্ঝরের ভালো লাগে না। এই অসহায় গাছের সাজানো প্রদর্শনীও তার আর ভালো লাগে না। সে দ্রæত বের হয়ে যায়। বাইরে বের হতেই কড়া রোদে তার মাথা চনচন করে উঠে। সেই সাথে পেটের ভেতর ক্ষুধাটা চনমন করে উঠে। হাতের দিকে তাকায় সময় দেখার জন্য। কিন্তু ঘড়িটা যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। তখনই মনে পড়ে সেটা কিছুদিন আগে পাশের রুমের ছেলেটার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে-মেসের খরচ মেটানোর জন্য। তখন পকেটে হাত দেয়। এখন বিলাসিতা বলতে শুধু এই চলমান কথা বলার যন্ত্রটাই আছে। কবি গুণ আদর করে এর নাম দিয়েছেন মুঠোফোন। কিন্তু এটা পোষা আর এক যন্ত্রণা। দু’দিন পর পরই তিনশ টাকা করে লোড করতে হয়। মাঝে মাঝে একদিনও যায় না। এটা এখন আসলেই তার জন্য যন্ত্রণা হয়ে গেছে। তবুও এটা বাদ দিয়ে সে জীবন ভাবতে পারছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই সে গেটের বাইরে চলে আসে। তার আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না। তাই যাত্রী ছাউনির বেঞ্চে বসে পড়ে। পেটের খিদে কিন্তু মোটেই কমেনি। সে মোবাইল বের করে সময় দেখে। দেখে দু’টা বেজে দশ। এ দেখে পেটের খিদে যেন আরো বেড়ে গেছে। পকেটে আবার হাত ঢোকায়। কিন্তু পাঁচ টাকার একটা ধাতব কয়েন ছাড়া আর কিছুই তার হাতে বাজে না। সে হিসাব মেলাতে পারে না। হঠাৎ মনে পড়ে গতকালই মোবাইলে দুইশো টাকার ফ্লেক্সি করেছে। তখন সব বিরক্তি গিয়ে পড়ে মোবাইলটার ওপর। মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে হয় মোবাইলটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। বরং তার অন্য কথা মনে পড়ে। সেদিন একটা দোকানে দেখে এক লোকের জরুরি একশ টাকার দরকার। লোকটা দোকানদারের মোবাইলে একশ টাকার ট্রান্সফার দিয়ে ক্যাশ একশ টাকা নিল। নির্ঝরের আইডিয়াটা বেশ ভালোই লেগেছে। সে আশেপাশে সে রকমের কোনো দোকান খুঁজে পায় না। তাই ভাবতে থাকে কী করা যায়। এখন মেসে গেলেও পায়ে হেঁটে যেতে হবে। আর সেখানে গিয়েও কোনো লাভ নেই। কেননা মেসে দুপুরে রান্না হয় না। তাই অন্য উপায় না দেখে ভাবতে থাকে পাঁচ টাকা দিয়ে কী পাওয়া যায়। সামনে বাদামের গাড়ি দেখে কোনো কিছু না ভেবেই তিন টাকার বাদাম কিনে ফেলে। বসে বসে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে চিবোতে থাকে। আর ভাবতে থাকে কবি সুকান্তের কবিতার কথা- ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। এরিমধ্যে বেরসিক মোবাইলটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ভেসে উঠে বাল্যবন্ধু তামিমের নম্বর। সে বুঝতে পারে না কি এমন জরুরি দরকার যে এই ভরদুপুরে কল দিয়েছে। তাই কল রিসিভ করে না। বাজতে বাজতে কেটে যায়। আবার বেজে ওঠে। এবার অনিচ্ছাসত্তে¡ও রিসিভ করে। ওপাশ থেকে বেশ আপন করা কন্ঠে- হাই দোস্ত কি খবর? নির্ঝর হঠাৎ করে এমন আন্তরিকতার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। কেননা এর আগে সে নিজেই বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেকবারই পাশ কাটানো উত্তর পেয়েছে। একবার তামিমের অফিসেও গিয়েছিল লিটল ম্যাগের অ্যাডের জন্য। বিশাল অফিস তার-বিশাল কাজ কারবার। কিন্তু তামিম তো অ্যাড দেয়ই নি বরং মনে হয়েছে কিছুটা বিরক্তই হয়েছে। তারপর নির্ঝর আর যোগাযোগ করেনি-তামিমও না। তাই আজ তামিমের এই ফোন করার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। তাই সে নিরুত্তাপভাবেই উত্তর দেয়-এই তো ভালো। তোর কি খবর?

-আমাদের আর খবর দোস্ত। আছি ব্যস্ততার মধ্যে। তুই এখন কোথায়?

-আছি। ঢাকা শহরেই আছি।

-কোথায় আছিস্ বল্। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি তোকে নিয়ে আসার জন্য।

-মানে? হঠাৎ?

-দোস্ত, এই শহরে তুই আমার একমাত্র বাল্যকালের দোস্ত। অথচ তোর কোনো খোঁজ খবর রাখতে পারি না। কতদিন ধরে তোর সাথে দেখা হয় না। দোস্ত, আইজ তোরে খুব দেখতে ইচ্ছা করতাছে। 

নির্ঝর হঠাৎ উথলে ওঠা এমন বন্ধুত্বের দরদের মানে বুঝতে পারে না। তাই পাশ কাটিয়ে বলে-দোস্ত, আইজ মন খারাপ। অন্য একদিন আসব। কিন্তু তামিম নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই ছাড়বে না।

-কি কস্ দোস্ত-তোর মন খারাপ! কবির আবার মন খারাপ কিসের? কবিরা তো বারোমাস ফুরফুরে মেজাজে থাকে। আয় চইলা আয়। একসাথে আড্ডা দিলে তোর মন ভালো হইয়া যাইব। একথা শুনেই নির্ঝরের মন খারাপ ভাব অনেকটা কেটে যায়। তবু সে ভরসা পায় না। তাই বলে-বাদ দে দোস্ত। আরেকদিন আসবো। 

- না না দোস্ত তোরে আইজই আসতে হবে। তুই কোথায় বল্। আমার ড্রাইভার এখনই গিয়ে তোকে তুলে নিয়ে আসবে। তারপর দু’জন মিলে একসাথে গল্প করতে করতে লাঞ্চ সারব। 

-দোস্ত, লাঞ্চতো সেরে ফেলেছি।

-তাই। কোথায়? রাস্তার পাশের সস্তা হোটেলে?

- না দোস্ত, একদম ফুটপাতে। শুকনো বাদাম চিবুচ্ছি।

- আফসোস্। দোস্ত, তুই ছিলি আমাদের প্রাইমারি স্কুলের ফার্স্টবয়। অংক, ইংরেজিতে সব সময় একশ পাওয়া ছেলে আর তুই দোস্ত তিন বেলা ভাত খাইতে পাস্ না। আফসোস্। জানোস দোস্ত, তুই যেদিন তোর প্রথম কবিতাটা আমারে দেখাইলি সেদিন ভাবছিলাম তুই একদিন ঠিকই রবীন্দ্রনাথ, শেলি ওগো মতো কিছু একটা হবিই। আর আইজ তোরে ফুটপাতে বসে শুকনো বাদাম চিবুতে অয়। আফসোস্। দোস্ত তুই অক্ষন আমার অফিসে চইলা আয়। তোরে আইজকা ফাইভ স্টার হোটেল থেইকা আইন্যা লাঞ্চ করাবো। 

-দোস্ত আইজ না। অন্যদিন আসব। 

- না না আইজই আয়। তোর সাথে ইমপরটেন্ট কথা আছে।

-কি কথা মোবাইলে বল। 

- না না মোবাইলে কওয়া যাইব না। পারসোনাল কথা। 

-অসুবিধা নাই বল্। আমার আশেপাশে কেউ নেই। 

- না মানে কথা হইছে- কেমনে যে বলি।

-কি?

-না, মানে সারাদিন ব্যস্ততার মধ্যে থাকি তো। কেমন রোবট রোবট মনে হয়। মাঝে মাঝে একটু আনন্দ ফুর্তিরও তো দরকার আছে। কি কস্ দোস্ত, দরকার আছে না?

-তা তো অবশ্যই।

-তো হেভি একটা পিস্ জোগাড় করছি। অনেক কষ্টে ম্যানেজ করছি। 

-বুঝলাম না। পিস্ কি?

-তোরে কেমনে বুঝাই। পিস্ মানে আর কি- মোবাইলে পরিচয়। তো অনেক কষ্টে ম্যানেজ করছি। একদিন দু’জনে একটু নিরিবিলি সময় কাটাব আর কি? হোটেল টোটেলে তো বুঝস্ কত ঝামেলা। পুলিশ, সাংবাদিক কত ঝামেলা হইতে পারে। 

এসব শুনে নির্ঝর একটু শক্ত হয়ে যায়। বলে- তা আমি করব?

-না মানে বলছিলাম তোর রুমটা তো দুপুরের দিকে খালি থাকে। তো তোর রুমের চাবিটা যদি দিস্। বেশি সময় নেব না। জাস্ট ঘন্টাদুয়েক- তারপর চলে আসব। 

-সরি দোস্ত। তুই অন্যকিছু বল্। আমি আমার বেস্ট ট্রাই করব। কিন্তু এটা পারব না। 

-কেন পারবি না। তোর তো কোন সমস্যা নেই।

-না না, দোস্ত আমারে মাফ কর। আমি পারমু না। 

-ক্যান, তোর সমস্যা কি? দরকার হইলে তোর পুরা মাসের রুম ভাড়া আমি দিমু।

-মাফ চাই দোস্ত।

-আচ্ছা যা তোর প্রথম কবিতার বই বের করার সমস্ত খরচ আমি দিমু। 

-সরি দোস্ত।

-আচ্ছা, দরকার হইলে তোর জন্যও এরকম আরেকটা পিস্ জোগাড় কইরা দিমু। যা ইচ্ছা তাই করতে পারবি। 

-দোস্ত আমারে মাফ কইরা দেওয়া যায় না।

হঠাৎ তামিম চটে যায়- হালার ভীতু কোথাকার। এজন্যই তো কই তোর কবিতা কেউ ছাপে না ক্যান। ব্যাটা কবি কি এমনে এমনে অওন যায়। পিকাসো, বোঁদলেয়র, র‌্যাঁবো ওদের লাইফ দেখছোস্। ওগো বায়োগ্রাফি পড়ছোস্। জানোস্ কত অ্যাডভেঞ্চারাস ছিল ওগো জীবনযাপন। হালার মাইয়া কোথাকার। বলেই লাইনটা কেটে দেয়।


বাল্যবন্ধুর এমন গায়ে পড়ে দুর্ব্যবহার তার মনকে আরো খারাপ করে দেয়। তার এই মুহূর্তে এই শহরে একটুও ভালো লাগে না। মনে হয়, এ শহর তার জন্য নয়। তার ইচ্ছে করে গাঁয়ে ফিরে যেতে। সেখানে গিয়ে গাঁয়ের ধারে নদীর তীরে শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় বসে থাকবে। নদীর জলে টগর ফুলের ভেসে যাওয়া দেখবে। দেখবে সাদা বকের উড়ে যাওয়া। দেখবে সাদা কাশের বন। কাশের বনের ভেজা মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খাবে। গায়ে মেখে নেবে সোঁদা মাটির গন্ধ। কিন্তু সে জানে এসব কিছুই সম্ভব হবে না। তার পক্ষে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। 

হঠাৎ সেদিন পত্রিকায় দেখা কবি সোহেল মাহরুফের একটা কবিতার শেষ কয়েক লাইন মনে পড়ে। মনে মনে লাইনগুলো আওড়ায়-


“যখন সকলেই ছুঁয়েছে কালিমা,

ডুবেছে আঁধারে

ভুলে নিজ নিজ ছায়া-

তখনও আমি ভালোবেসে

শুভ্র ও সুন্দর 

আজ সেজেছি বেহায়া। ”


নির্ঝরের মন আরো ভারাক্রান্ত হয়। বুক ভেঙে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস।  





Comments: