প্রতীক্ষা

প্রতীক্ষা

সোহেল মাহরুফ



ট্যাক্সিতে ওঠার পরও আয়েশার বিরক্তি ভাবটা কাটে না। এটা অবশ্য শুরু হয়েছে সেই অস্ট্রেলিয়া থেকে। তারপর থেকে কমার নাম নেই। বরং বেড়েই চলছে। সে প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে দেশে এসেছে। উপলক্ষ আর কিছুই নয়- তার ছোট বোনের বিয়ে। এটা না হলে হয়ত এবারও তার আসা হত না। কিন্তু এই আসাটা তার কাম্য ছিল না। জুবায়েরকে ছাড়া একা একাই তাকে আসতে হয়েছে। আর সেখান থেকেই বিরক্তির শুরু।

আসলে সবকিছুই পরিকল্পনা মাফিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ বাঁধ সেধে বসেছে জুবায়েরের ছুটি। জুবায়ের ওখানে এমবিএ করেছে। লাস্ট সেমিস্টার শেষ করার জন্য কিছুদিনের ছুটি নিয়েছিল। এই জন্য আর ছুটি নিতে পারেনি। তাই তার আর দেশে আসা হল না। এই নিয়ে দু’জনের ঝগড়াঝাটি- দু’তিন দিন মন খারাপ অবস্থা। তারপর একা একাই দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে। একে তো এত দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের ক্লান্তি। তার ওপর এয়ারপোর্টের নানান ফরমালিটিজের হেসেল- সব মিলিয়ে তার তখন বিধ্বস্ত অবস্থা।


ঝামেলার কারণে সে বাসার কাউকে তার অ্যারাইভ্যাল টাইম জানায়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা তার বোকামিই হয়েছে। বিশেষ করে, ট্যাক্সি নিতে গিয়ে তা হাড়ে হাড়ে টের পেল। প্রথমে সিদ্বান্ত নিতে পারছিল না কোথায় উঠবে- বাপের বাসায় যাবে না শ্বশুরের বাসায়। পরে সিদ্ধান্ত নিল শ্বশুরের বাসাতেই উঠবে। কিন্তু ট্যাক্সি নিতে গিয়েই বাঁধলো বিপত্তি। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি বলে কোন ট্যাক্সিই যেতে চায় না। অনেকক্ষণ পরে এই ট্যাক্সিটা পেল। ড্রাইভার দরজায় হেলান দিয়ে তার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল। জিজ্ঞেস করতেই প্রথমে না বলল। তারপর যখন সে বলল- তোমার মিটারে যা ভাড়া আসবে তার ডাবল ভাড়া দেব। তখন হঠাৎ পিছনে তাকাল। হঠাৎ তার নিস্পৃহ ভাব কেটে যায়। সে তড়িঘড়ি করে মালপত্র গাড়িতে তুলল। ড্রাইভারকে দেখে আয়েশা কিছুটা অবাক হয়ে যায়। এত হ্যান্ডসাম ছেলে ট্যাক্সি চালায়! ভাবতেই তার কাছে অবাক লাগল। তার ওপর তার এই হঠাৎ রূপ বদলটাও আয়েশার কাছে সন্দেহজনক মনে হল। কিন্তু সে ট্যাক্সি পেয়েছে তাতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। অন্য কিছু ভাবতে চাচ্ছে না। ট্যাক্সিতে উঠার পরেই ছেলেটা একটা সফট্ টাইপের রক গান ছেড়ে দেয়। লো ভলিউমে ভালই লাগছিল। কিন্তু একটা গানই রিপিটডলি বাজাচ্ছে। প্রথমে ভালো লাগলেও এখন বিরক্তিকর লাগছে। শুনতে শুনতে গানটি তার মুখস্থ হয়ে গেছে। গানটির মূল বিষয় হচ্ছে একটি মেয়ের জন্য একটি ছেলের প্রতীক্ষা। এই কয়েকবার শুনেই পুরো গানটি তার মুখস্থ হয়ে গেছে। গানের কথাগুলো সে নিজের মনে আওড়াতে থাকে-


“সময়ের প্রতিক্ষণ কাটে... তোমারই প্রতীক্ষায়... অশ্রæর প্রতি ফোঁটায় ভেজে--- আমার ফেলে আসা পথটা-

অপলক চোখে চেয়ে থাকা... সীমাহীন ঐ সীমানায়... যদি তুমি আসো ফিরে... আবারও আমারি কাছে-”

চোখ বুঁজে গানের কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই সে চোখ মেলে তাকায়। গিয়ারের ওপরে রাখা ছেলেটার হাতের উপরে চোখ পড়তেই সে চমকে উঠে। দেখে ছেলেটার হাতে অরজিনিয়াল রোলেক্স ঘড়ি। ভাবে, বাংলাদেশের একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার কত টাকা পায় যে রোলেক্স ঘড়ি পরতে পারে। পরক্ষণেই তার অন্য ব্যাপার মনে পড়ে। সেই সাথে রাজ্যের ভয় এসে মনে ভিড় করে। শুনেছে ঢাকার ট্যাক্সি ড্রাইভাররা নাকি হাইজ্যাকারদের সাথে হাত মিলিয়ে যাত্রীদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। ভাবে ছেলেটাও হয়তো সেরকম কিছুই করেছে। নইলে ট্যাক্সি চালিয়ে হাতে রোলেক্স ঘড়ি পরবে! ভাবতেই রাজ্যের ভয় তাকে কাবু করে। সে নিজের বোকামির জন্য নিজের ওপরই বিরক্ত হয়। বিশেষ করে কাউকে খবর না দেয়ার জন্য এখন তার অনুতাপ হয়। ভাবতে ভাবতেই সে রিয়ার-ভিউ মিররের দিকে তাকায়। ছেলেটার চোখে চোখ পড়ে যায়। সে চোখ সরিয়ে নেয়। ভাবে, ছেলেটি নিশ্চয়ই তাকে দেখার জন্যই মিররটি এভাবে সেট করেছে। সে আরও অস্থির হয়ে ওঠে। ভাবে, তার শ্বশুরের বাসাতো এয়ারপোর্ট থেকে কাছে। এতক্ষণ সময় তো লাগার কথা না। তবে কি ছেলেটা তাকে অন্য পথে ঘুরিয়ে নিচ্ছে। সে কিছু বলতে যায়। এর ভেতরেই মোবাইলের সুমিষ্ট রিংটোন বেজে ওঠে। ছেলেটি পকেট থেকে দামি মোবাইল সেট বের করে কথা বলতে শুরু করে। দেখে আয়েশা আরও অবাক হয়ে যায়। তার আরও বেশি অবাক লাগে ছেলেটির ভয়েস শুনে এবং কথা বলার স্টাইল দেখে। ট্যাক্সিতে ওঠার সময় যে ভয়েস শুনেছিল তার সাথে এখনকার ভয়েস টোটালি ডিফারেন্ট। তখন কেমন সাবমেসিভ শোনচ্ছিল আর এখন কমান্ডিং। কার কাছে থেকে যেন ইনফরমেশন নিচ্ছে- সবই বিজনেস রিলেটেড। আয়েশার বিরক্তির মাত্রা বেড়ে যায়। বিশেষ করে গাড়ি চালানো অবস্থায় এত দীর্ঘক্ষণ মোবাইলে কথা বলতে দেখে। সে ধমকের সুরে বলে- এ্যাই গাড়ি পাশে দাঁড় করিয়ে কথা বল। ছেলেটিও বাধ্য ছেলের মত গাড়ি পাশে দাঁড় করায়। কিন্তু তার কথা ফুরায় না। কথা শেষ হতেই সে আরেকটি নম্বরে রিং করে। এবার ইংরেজিতে কথা বলে। স্পষ্ট ইংরেজিতে সে কথা বলছে। কথা শুনে আয়েশা বুঝতে পারে ছেলেটা হয়তো কোন বিদেশি বায়ার এর সাথে কথা বলছে। সেলস কন্ট্রাক্ট এর বিভিন্ন দিক নিয়ে তারা কথা বলে। এ শুনে ছেলেটার সম্বন্ধে তার কিউরিসিটি বেড়ে যায়। সে রহস্য বের করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ফোনটা রাখতেই সে পেছন থেকে ডাক দেয়- এক্সকিউজ মি।


ছেলেটা পেছনে তাকাতেই সে অবাক হয়ে যায়। তার চোখ পড়ে ছেলেটার কপালের কোণের কাটা দাগের ওপর। এ যে তাহিম- হ্যাঁ, তাহিমই তো। তার সব সুন্দরের ভেতরে একটাই ক্ষত ছিল। আর তা তার ঐ কপালের কোণের কাটা দাগ। আর সেটাই তাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। তার চেহারায় অন্য একটা ডাইমেনশন এসেছে। আয়েশার সব আশঙ্কা নিমেষেই উধাও হয়ে যায়। সে তার উচ্ছ¡াস আর চেপে রাখতে পারে না। বলে উঠে- আরে তাহিম, তুমি! ওয়াট এ্যা সারপ্রাইজ! তুমি ট্যাক্সি চালাচ্ছো? 

তাহিম কিছু বলে না শুধু বিষণœœ হাসি হাসে। কিন্তু এতদিন পরে আয়েশা আর তার আবেগ চেপে রাখতে পারে না। সে তাহিমের পাশের সিটে এসে বসে। জিজ্ঞেস করে- তা কি খবর বল?

তাহিম আগের মতই নিরুত্তাপ উত্তর দেয়- ভালো । তোমার কি খবর?

-ভালো। আর বল না হঠাৎ ছোট বোনের বিয়ে তাই চলে আসতে হল। ওহ তুমিতো জান না বোধ হয় যে আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকি।

-জানি। তা তোমার হাজব্যান্ড আসেনি?

-আর বলো না অফিস থেকে ছুটি পায়নি তাই আসাও হয়নি। আশ্চর্য আমার বিয়ের খবর তো তোমার জানার কথা না। তুমি জানলে কি করে?

-এই আর কি?

-কিন্তু তাহিম আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না যে তুমি ট্যাক্সি চালাচ্ছো। ব্যাপার কি খুলে বলতো।

তাহিম রহস্য করে জবাব দেয়- “কোন কোন প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়।”

-তাহিম! তুমি! কবিতা আওড়াচ্ছ! এটাও একটা সারপ্রাইজ। কিন্তু আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না যে তুমি ট্যাক্সি চালাচ্ছ। এতদিনে নিশ্চয়ই বিয়ে করেছ? তা তোমার বউ এর খবর বল।

-বিয়ে! বউ!

-মানে! তুমি এখনও বিয়ে করনি?

-হুঁ করেছি।

-একদিন তোমার বউ দেখতে যাব। নিয়ে যাবে তো।

-এখনই চল।

-মাত্থা খারাপ। আমাকে আগে আমার শ্বশুরের বাসায় পৌঁছে দাও। তা তুমি এখনও বললে না কিন্তু তুমি ট্যাক্সি চালাচ্ছ কেন?

তাহিম যেন আর কোন কথা খুঁজে পায় না। সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে। আয়েশা ভাবে তাহিম বোধ হয় এ প্রশ্নে বিব্রত বোধ করছে। সে প্রসঙ্গ পাল্টায়।

-তাহিম, তোমার মনে আছে সেই স্কুলের দিনগুলোর কথা। আমরা স্কুল পালিয়ে সেই বলধা গার্ডেনে যেতাম। আমি, তুমি, সাদ, রাইমা, রুহিতা। আচ্ছা ওরা এখন কে কোথায় আছে?

-জানি না। আমার সাথে কারও যোগাযোগ নেই।

-সাদ অবশ্য প্রায়ই আমাকে ফোন দ্যায়। সে তো এখন পেনসিলভিনিয়ায় আছে।

-তাই!

-আচ্ছা তাহিম তুমি এমন কেন?

-কি রকম?

-না মানে সেই স্কুল কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়েছি। আমরা ছিলাম একে অপরের আত্মার আত্মীয়। অথচ ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েই তুমি বদলে গেলে। সবার থেকে কেমন দূরে সরে গেছ। 

-কই? আমার তো সেরকম মনে হয়না।

-তোমার মনে হলে তুমি নিশ্চয়ই এমনটি করতে না। জানো তাহিম, তোমার জন্য আমি আমার জীবনে অনেক বড় বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

হঠাৎ এ কথা শুনে তাহিম অবাক হয়ে যায়। বিস্মিত চোখে তাকায়- মানে?

-তাহিম আমরা তো সেই ছোটবেলা থেকেই একসাথে বেড়ে ওঠেছি। সেই ছোট ছোট সুখ দুঃখগুলো আমরা সবসময়ই শেয়ার করতাম। মনে হত জীবনটা বুঝি এভাবেই চলে যাবে। কিন্তু ইন্টার পরীক্ষার পর হঠাৎ তুমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে। তখনই তোমাকে ফিল করতে শুরু করলাম। বুঝলাম, তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা সম্ভব না। আমি যতই তোমাকে ভুলে থাকতে চাইছিলাম তত বেশি করে তোমার ভাবনায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। এরপর আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেলাম- ভর্তি হলাম। এর পেছনে একটাই কারণ ছিল যে তুমিও যেহেতু ডাক্তার হতে চাইতে তাই আমিও ডাক্তার হলে ভালোই হবে। আর হয়তো সেখানে আমাদের আবার যোগাযোগ হবে। কিন্তু পরে শুনলাম তুমি আইবিএ তে ভর্তি হয়েছ। আমার আর ডাক্তারি পড়া ভালো লাগছিল না। তাই একবছর গ্যাপ দিয়ে আবার আইবিএ তে পরীক্ষা দিলাম। কিন্তু টিকলাম না। তারপর জার্নালিজমে ভর্তি হলাম। ভাবলাম, হয়তো তোমার সাথে আবার যোগাযোগ হবে। কিন্তু না কিছুতেই সম্ভব হলো না। শুধু দূর থেকে তোমার খবর রাখতাম আর দিন গুনতাম কবে তোমার সাথে দেখা হবে। জমানো কথাগুলো মনের সাধ মিটিয়ে বলব। কিন্তু সেই দিনটি আর যেন আসছিল না। এভাবে দেখতে দেখতে তিন বছর চলে গেছে। তখন হঠাৎ খালাতো ভাই জুবায়ের অস্ট্রেলিয়া থেকে আসল। আব্বু আম্মুর কাছে প্রপোজাল পাঠাল। আমিও ভাবলাম আর কত মিথ্যা আশায় বসে থাকব। আর যার জন্য বসে আছি সে ই যখন যোগাযোগ রাখতে চায় না তখন আর বসে থেকে লাভ কি? তাই রাজী হয়ে গেলাম। কিন্তু এতদিনে বুঝতে পারছি আমার সেই ধারণাটা ই ঠিক ছিল। অর্থাৎ তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এখন শুধু বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে আছি। বলেই সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে।

তাহিমেরও বুক ভেঙে দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না। শুধু আয়েশার হাত চেপে ধরে। আর অস্ফুট স্বরে বলে উঠে- আয়েশা।

আয়েশা নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। বলে- বাদ দাও ওসব কথা। যা হবার হয়েছে। তোমার কথা বল। তোমার এই ট্যাক্সি চালানোর রহস্য বল।

-আয়েশা, আজ তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে আমি বোকা- ভীষণ বোকা।

-মানে?

-জানো, আমি সবসময় ভাবতাম যে তুমি মনে হয় সাদকে পছন্দ কর। তাই আমি বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে কখনও তোমাকে আমার ভালোবাসার কথা জানাইনি। বরং সবসময় চেষ্টা করেছি নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে। না পারতে অনেক সময় তোমাদের এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু সবসময় বন্ধুত্বের জালে ধরা পড়েছি। তারপর কলেজ শেষে মনে হল এটাই তোমাকে ভুলে যাওয়ার সুযোগ। তাই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলাম। কিন্তু লাভ হল না। তোমাকে যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম ততই মনে পড়তে লাগল। এরপর এক দেড় বছর কেটে গেছে তোমাদের কারো সাথেই আর যোগাযোগ হয়নি। আমারও মনে হল আমি বুঝি ধীরে ধীরে সব ভুলে গেছি। ঠিক তখনই একদিন টিএসসিতে তোমাকে দেখি। খুব ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও তোমার সাথে কথা না বলে তোমাকে এড়িয়ে যাই। এরপর খবর নিয়ে জানতে পারি তুমি জার্নালিজমে ভর্তি হয়েছ। তারপর প্রায়ই তোমাদের ডিপার্টমেন্টের দিকে যেতাম। দূর থেকে তোমাকে দেখতাম। তোমাকে দেখলেই মনে হতো তুমি শুধু আমার জন্যই। আমার কাছে থেকে তুমি কখনও হারিয়ে যাবে না। ভাবতেই আমি নূতন উদ্যোমে পড়াশোনা শুরু করলাম। ভাবলাম পড়াশোনা শেষ করেই তোমাকে সরাসরি প্রপোজ করবো। এভাবে ভালোই চলছিল। বিবিএ শেষ হতে না হতেই একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যাই। তারপর যখন ভাবলাম তোমাকে প্রোপোজ করবো ঠিক তখনই খবর নিয়ে জানতে পারি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি অস্ট্র্রেলিয়া চলে গেছো। 

আয়েশার দু’চোখে অশ্রæ ঝরে। বলে-তাহিম সেদিন এ কথাগুলো যদি আমি জানতাম...

-আয়েশা, সবই আমার ভুল। সব আমারই বোকামি।

-বাদ দাও। তারপর বল- তোমার এই ট্যাক্সি চালানোর রহস্যের কথা।

-না মানে তোমার বিয়ের কথা শুনে আমার মাথা ওলটপালট হয়ে যায়। সারাক্ষণ তোমার কথাই ভাবতাম। অফিস-চাকরি আর ভালো লাগত না। নানাভাবে তোমাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। ব্যবসা শুরু করলাম। ভাবলাম, ব্যস্ততায় থাকলে হয়তো সব ভুলে যাব। যদিও ব্যবসায় ভালো করছিলাম কিন্তু তোমাকে ভুলতে পারলাম না। সারাক্ষণ মনে হত আমি হেরে গেছি। আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম তাকে তা বলতে পারলাম না। আমি হেরে গেছি। তখন হঠাৎ মাথায় একটা আইডিয়া আসে। ভাবলাম, তুমি তো একদিন না একদিন বাংলাদেশে আসবে- তখন আমার ভালোবাসার কথা বলব। সেই ভাবনা থেকেই এই ট্যাক্সিটা কিনে ফেললাম। তারপর অস্ট্রেলিয়া থেকে যাত্রীরা কোন কোন এয়ারে কখন এসে পৌঁছে তার একটা সিডিউল নিয়েছি। আর প্রতিদিন সিডিউল অনুযায়ী এসে ওয়েট করি। প্রত্যেকদিনই ভাবি আজ বোধ হয় তোমার সাথে দেখা হবে। কিন্তু কত মানুষ আসে তবু তুমি আস না। এভাবে করতে করতে আজ দুই বছর হল।

আয়েশা অবাক চোখে তাহিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলবে খুঁজে পায় না। তারপর হঠাৎ বলে উঠে-  তোমার বউ এসব জানে?

-বউ! হাঃ হাঃ হাঃ। বউ থাকলে তো জানবে।

তাহিমের হাসি শুনে আয়েশা আঁতকে ওঠে। বলে- মানে! তুমি এখনও বিয়ে করোনি!

-আয়েশা, তোমার জায়গায় আমি এখনও অন্য কোনো মেয়েকে ভাবতে পারি না। আয়েশা তাহিমের বিষন্ন চেহারার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তাকে এখন আর স্বাভাবিক মানুষ মনে হয় না। তার চেহারার ভেতর কেমন যেন একটা পাগল পাগল ব্যাপার চলে এসেছে। সে আর কথা খুঁজে পায় না। তাদের দু’জনার নীরবতা ছাপিয়ে সিডি প্লেয়ারে বেজে চলে-

“অপলক চোখে চেয়ে থাকা... স্বপ্নহীন ঐ সীমানায়... অনুভবে তোমায় পাই... অপূর্ণ এক পূর্ণতায়-”।





Comments: