একদিন স্বপ্নের দিন

একদিন স্বপ্নের দিন

সোহেল মাহরুফ


সূর্যটা পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। তার রঙে কেমন যেন ক্লান্তির ভাব। এই গোধূলি লগ্নের ক্লান্তি যেন প্রকৃতিকেও গ্রাস করেছে। তবু এই স্টিমার ঘাটে তার কোনো ছিঁটেফোঁটাও নেই। বরঞ্চ মানুষের পায়ের গতি যেন এখানে ছন্দ পায়। স্টিমারের ঘন ঘন ভেঁপু যেন তার ওপর রাখালের পাছনের ঘা। মবিন অনেক কষ্টে নির্দিষ্ট স্টিমারে উঠল। মবিন- পুরো নাম মবিনুল ইসলাম। বাড়ি বরিশাল। পেশায় ক্যামেরাম্যানের অ্যাসিসট্যান্ট। পেশার কথা বলতে সে যতটা আনন্দ পায় কিন্তু আয়ের কথা বলতে ততটা নয়। উপার্জন যদিও কম কিন্তু অহংকারে কোনো ঘাটতি নেই। আর এই অহংকারের জোরেই সে অনেক কিছু করে ফেলে। যেমন আজকের কথাই ধরা যাক। সে সিঙ্গেল মানুষ- পঞ্চাশ/একশ টাকা দিয়ে ডেকের একটা সিট নিলেই রাতটা তার দিব্যি চলে যায়। কিন্তু সে মিডিয়ার লোক। ওভাবে গেলে তার প্রেস্টিজ থাকবে না। তাই সে এক হাজার টাকা দিয়ে একটা ভিআইপি কেবিন ভাড়া করেছে। ভিআইপি কেবিন মানে সেইরকম একটা ব্যাপার- এসিরূম, ডাবলবেড, সোফাসহ আরও অন্যান্য আয়োজন। মবিন এসব সুযোগ সুবিধা কিংবা আরাম আয়েশের কথা তেমন একটা ভাবে না। তার কাছে ভালো লাগে এই যে সবাই তাকে একজন বিশেষ কিছু ভাবছে, কেবিন বয়রা তাকে দেখলেই সালাম দিচ্ছে, ব্যস্ত ত্রস্ত হয়ে তার ফরমায়েশগুলো খাটছে- এইসব। যদিও এক হাজার টাকার জন্য তার মনটা একটু খুঁতখুঁত করে। তবু এই যে সবাই তাকে বিশেষ কিছু মনে করে- এর কাছে তা কিছুই না। তাই সে শুয়ে শুয়ে পা নাচায় আর ছাদের দিকে তাকিয়ে মনের সুখে শিস্ বাজায়।


হঠাৎ দরজায় নক্ করা শুনে সে বিরক্তি বোধ করে। ভাবে, কোনো কেবিন বয় হয়তো জিজ্ঞেস করতে এসেছে তার কিছু লাগবে কি না। সে তাকে বড়সড় একটা ধমক দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে দরজা খুলে। কিন্তু দরজা খুলে দেখে স্বয়ং লঞ্চের মাস্টার মুখ কাঁচুমাঁচু করে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে তার মায়া হয়। সে জিজ্ঞেস করে- কি ব্যাপার?

-স্যার, একটা ফ্রোবলেম হইয়া গ্যাছে।

- প্রোবলেম! কি সমস্যা?

-স্যার, ম্যাডাম আইছেন।

ম্যাডামের কথা শুনেতো মবিনের চোখ কপালে। ভাবে, এ ব্যাটা আবার কোথাকার কোন ম্যাডাম ধরে নিয়ে এসেছে। তার বিস্ময় চাপা থাকে না। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে- ম্যাডাম!

- জ্বে মানে ঐ নাটকের আফা। ঈশিতা আফা। 

মবিন ব্যাপারটা অনুমান করতে পারে। সে কিছুটা উৎফুল­ হয়ে উঠে। তবু সে মাস্টারের কাছে নিজেকে পুরোপুরি খুলে দেয় না। 

-আমি কি করবো?

-না মানে কেবিন সবগুলা বুক হইয়া গেছে। আর বুঝেন তো উনারা হচ্ছেন ইস্টার। উনারা তো আর ডেকে থাকতে পারেন না। তাই বলছিলাম মানে----

অনুমান মিলে গেছে দেখে মবিন উৎফুল্ল­ হয়ে উঠে। তবু আদেশের সুরে মাস্টারকে বলে- আচ্ছা যান। নিয়ে আসেন।


মাস্টার আর দু’তিনজন বয় মিলে যাকে নিয়ে এসেছে সে মোটেই ঈশিতা নয়। তবু তাকে দেখে মবিনের ইচ্ছে করছে বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দিতে। আসলে জাহাজের মাস্টার সাথে করে যাকে নিয়ে এসেছেন তিনি হচ্ছেন স্বয়ং অপি করিম। মবিন কতদিন কল্পনা করেছে এমন একটি দৃশ্যের কথা। ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে লাইট-ক্যামেরা- অ্যাকশন- কাট শুনতে শুনতে যখন ক্লান্তিতে দু’চোখ বুঁজে আসতো, মনে হতো- এই বুঝি অপি করিম হাতের গোলাপটা নায়ককে না দিয়ে তার দিকেই ছুটে আসছে। কিংবা যখন শুটিং শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসে করে বাসায় ফিরতো মনে হতো এই বুঝি অপি করিম পাশে এসে বসলো- এই বুঝি হাসি হাসি মুখ তুলে বললো- কেমন আছেন মবিন ভাই? কোথায় যাচ্ছেন?

মবিনের ভাবনায় ছেদ ঘটাতেই যেন অপি করিম মুখ খুলল-

-আরে মবিন ভাই! আপনি!

মবিনের বিস্ময়ের যতটুকু বাকি ছিল তাও পূরণ হলো। অপি করিম তাকে মবিন ভাই বলে ডাকছে। অথচ শুটিং স্পটে কোনদিন কথা বলেছে কিনা সে তাও মনে করতে পারছে না। অপি করিম কথা চালিয়ে যায়-

-দেখেনতো কি একটা বিশ্রি ব্যাপার হয়ে গেল। হঠাৎ করে বরিশাল যেতে হচ্ছে- কোন প্রস্তুতি ছাড়া মানে----

লঞ্চের মাস্টার তাদের অন্তরঙ্গ কথাবার্তা দেখে কিছু একটা অনুমান করে নেয়। তারপর নিজের দায়িত্ব লাঘব হয়েছে দেখে খুশি মনে বিদায় নেয়।


শান্ত জলের বুকে তরঙ্গ তুলে লঞ্চ এগিয়ে চলে। মবিন আর অপি বসে আছে কেবিনের সামনে- করিডরে। লঞ্চ এখন মেঘনা পাড়ি দিচ্ছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। মেঘনার জলে নাচছে চাঁদের ছায়া। দু’জনেই তাকিয়ে থাকে জলের পানে-দেখে জলের বুকে চাঁদের নাচন। মবিন কিছু বলতে চায়। কিন্তু অপি তাকে থামিয়ে দেয়। বলে-

-আজ সারারাত জলের বুকে চাঁদের ছায়া দেখে কাটাব।

মবিন জবাবে বলে- তুমি চাইলে সারারাত কেন সারাটাজীবন জলের বুকে চাঁদের ছায়া দেখে কাটিয়ে দিতে পারি।


জবাবে অপি কিছু বলে না। শুধু জলের পানে চেয়ে থাকে। আর মবিন চেয়ে থাকে অপির মুখের পানে। আকাশের চাঁদের আলোয় দেখে ধরার চাঁদ। মবিন হাত ধরার জন্য হাত বাড়ায়। অপিও হাত বাড়িয়ে দেয়। হঠাৎ প্রচন্ড চিৎকার। অন্ধকার হয়ে যায় চারিদিক। অন্ধকারে হারিয়ে যায় অপির হাত। মবিন কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সে দিগি¦দিক শূন্য হয়ে ছুটতে থাকে। খঁুঁজতে থাকে অপি করিমের হাত। হঠাৎ কিসের সাথে যেন প্রচন্ড ধাক্কা খায়। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে। হঠাৎ হাতে ঠেকে ওর খাটের এক কোণা। মুহূর্তেই তার সব কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।


আসল ব্যাপারটা হলো আজ গাজীপুরে শুটিং ছিল। মাহফুজ আর অপি করিমের নাটক। সেই সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা। বাসায় ফেরে সন্ধ্যা সাতটায়। মেসে ফিরেই ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দেয়। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা টের পায়নি। আর ঘুমের অবসরেই ঘটলো এতসব। ঘুম থেকে জেগেই মবিন ব্যাপারটার ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করছে। মি. ফ্রয়েডের মতে এর ব্যাখ্যা হচ্ছে আজ সারাদিন তার অবচেতন মন এসব ভেবেছে আর ঘুমের অবসরে তা তার মস্তিষ্কের সামনে তুলে ধরেছে। কিন্তু চিৎকারের ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে না। অথচ চিৎকারের শব্দটা সে স্পষ্টই শুনেছে। 


হঠাৎ দরজার দিকে তাকাতেই দেখে খোলা দরজা দিয়ে মোমের আলো আসছে। আলোটা মেস সুপারের রুম থেকে আসছে। হঠাৎই রহস্যের পর্দা খসে পড়ে। নিজেকে তখন তার মিসির আলী মিসির আলী মনে হয়। আর সেই খুশিতেই মুখ খানিকটা বাঁকা হয় চাপা হাসিতে। আসল ব্যাপারটা হলো এ মেসের একমাত্র টিভিটা আছে মেস সুপারের রুমে। সন্ধ্যার পরে সবাইই সেখানে জড়ো হয়। রাত দশটা পর্যন্ত সেখানেই কাটায়। এতক্ষন হয়তো কোন ভালো নাটক অথবা অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠানের মাঝখানে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়াতেই হয়ত সবাই চিৎকার দিয়ে উঠেছে।


কিছুক্ষণ বসে থেকে মবিন বিছানা ছাড়ে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে টেবিল থেকে মোম হাতে নেয় কিন্তু লাইটারটা যেখানে থাকার কথা সেখানে পায় না। না পেয়ে সে ভাবে হয়তো কেউ সিগারেট ধরানোর জন্য নিয়ে গেছে। তারপর কাজ শেষে নিজের মনে করে সেটিকে আর জায়গা মত রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। অজানা সন্দেহজনক ভদ্রলোকের বিবেচনার কথা ভেবে সে মনে মনে হাসে। চোরকে উদ্দেশ্য করে বলে- মামা আইডিয়াটা খারাপ না। 


তবে খারাপ দিকটা হচ্ছে লাইটারটা তার বড় শখের লাইটার ছিল। বেশ দামীয় জিনিসটা। ইন্ডিয়ান এক ভদ্রলোক দিয়েছেন। সেটা আরেক মজার গল্প। ভদ্রলোক কি একটা অনুষ্ঠান বানানোর জন্যে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাদের পুরো ইউনিট ভদ্রলোকের সাথে বিভিন্ন লোকেশনে প্রায় একমাস কাজ করেছে। ভদ্রলোকের লাইটারটি এত সুন্দর ছিল যে সে প্রথম দেখাতেই সেটির প্রেমে পড়ে যায়। যখনই ভদ্রলোক সিগারেট ধরাতেন তখনই সে কাজটাজ ফেলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো তার লাইটারের দিকে। ভদ্রলোক হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করেছিলেন। তাই শেষের দিন তিনি তাকে কাছে ডেকে তার নাম, বাড়ির ঠিকানা সব জিজ্ঞেস করলেন। তারপর পকেট থেকে লাইটারটি বের করে দেখিয়ে বললেন- এটি কি তোমার খুব পছন্দ হয়েছে?

পুরো ইউনিটের সামনে তারতো তখন লজ্জায় মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু লাইটারটি হাতে পাওয়ার পরে সে নিমেষেই সব লজ্জার কথা ভুলে গিয়েছিলো। এখন লাইটারটির কথা ভেবে তার কষ্ট হচ্ছে। তার চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে তাকে এখন অন্ধকার হাতড়ে মেস সুপারের রুমে গিয়ে মোম জ্বালাতে হবে।


মবিন রুমে ঢুকতেই ছোটখাটো একটা শোরগোল পড়ে গেল-

-আরে ডাইরেক্টর সাব এতক্ষণ কই ছিলেন? মবিন বাদে মেসের বাকি ঊনিশজন বোর্ডার প্লাস মেস সুপার সুলেমান মিয়াসহ মোট বিশ জোড়া চোখ এই প্রশ্নের সাথে সাথেই যেন মবিনের ওপর হামলে পড়ল।

মবিনকে মেসের সবাই ডাইরেক্টর বলে সম্বোধন করেন। এটা তাদের অজ্ঞতা নাকি সচেতন কৌতুক- মবিন কখনও সে প্রশ্নে যায় না। বরং সে এরূপ সম্বোধনে পুলকিতই বোধ করে। কিন্তু আজ তেমন ইন্টারেস্ট পাচ্ছে না। বিশেষ করে কিছুক্ষণ আগের অপি করিম অ্যাডভেঞ্চারের ফলাফলস্বরূপ এখনও তার মাথা ঝিমঝিম করছে। তাই সে না পারতে ওষুধ গিলা টাইপের হাসি দিয়ে সভার মাঝখানে রাখা মোমের দিকে এগিয়ে গেল। মবিনের রুমমেট অতি উৎসাহী মিজান সাহেব তার মুখের দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলেন- ডাইরেক্টর সাব, আপনি তো দেখলেন না - যেই একখান নাটক লাগাইছিল না। ঐ কি যেন নাম মাইয়াডার....

মিজান সাহেব খুব করে চেষ্টা করছেন মেয়েটির নাম উদ্ধারের। তার অবস্থা এমন যেন নামটি এই মুহূর্তে বলতে না পারলে তার চৌদ্দগোষ্ঠীর মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। মিজান সাহেবের পাশেই বসে ছিলেন নূর সাহেব। পুরো নাম আহমেদ নূর। কিন্তু মেসের সবাই তাকে আসাদুজ্জামান নূর বলেই ডাকেন। কিন্তু নামের এই অংশটুকু ছাড়া তার আর কিছুই আসাদুজ্জামান নূরের সাথে মিলে না। না আছে তার অমন সুন্দর দাড়ি- না আছে অমন সুন্দর হাসি। চেহারার মধ্যে কেমন যেন একটা হিংস্র হিংস্র ভাব। যদিও তিনি মোটেই সেরকম নন। কেমন যেন একটু সোজা- নরম নরম টাইপ। সারাক্ষণই পান চিবান। যখনই দেখা হয়- দেখা যায় গরুর মতো মুখ নাড়ছেন। আর মুখ ভর্তি পানের রস নিয়ে যখন হাসি দেন তখন ঠোঁটের কোণা দিয়ে পানের রস গড়িয়ে পড়ে সে এক রক্তারক্তি ব্যাপার মনে হয়। পাশে বসে থাকা নূর সাহেব মিজান সাহেবকে তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। তার সেই রক্তারক্তি মার্কা হাসি সহকারে বললেন- অপি করিম, অপি করিম। 

আর্কিমিডিস তার সূত্র আবিষ্কারের পরে যেমন করে ইউরেকা ইউরেকা বলেছিলেন- মিজান সাহেবও মেয়েটির নাম উদ্ধার করতে পেরে তেমন করে বলে উঠলেন- হ্যাঁ, হ্যাঁ, অপি করিম, অপি করিম। আর বলবেন না ভাই, মেয়েটারে যা দেখাচ্ছিল না! শালার ইলেকট্রিসিটি... আর যাওয়ার সময় পাইলো না।

মবিন কিন্তু আগের মতই নির্লিপ্ত। এ দেখে মতলুব সাহেব, ফোঁড়ন কাটায় যিনি বিশেষভাবে দক্ষ, বলে উঠলেন- আরে ভাই কারে কি বলেন- মায়ের ধারে মামু বাড়ির গল্প!

তখন পাশে থাকা নূর সাহেব আবার তার সেই রক্তারক্তি মার্কা হাসি নিয়ে- তাইতো, তাইতো! ডাইরেক্টর সাব তো সারাদিন এদের মাঝেই থাকেন। তিনি আবার এখানে কি দেখবেন। তা ডাইরেক্টর সাব এরা সামনাসামনি দেখতেও কি এমন সুন্দর?

মবিন ভাবলো বেশ ভালো একটা ঝামেলায় পড়া গেলো। এখন কিছু না বলে এখান থেকে চলে গেলে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে। তাই মোম জ্বালানো হলেও সে উঠে না গিয়ে আবার বসে পড়লো। হাতের মোমটা নিভিয়ে জবাব দিলো- হ, সুন্দর। এইখানে আর কি দেখেন- এর চেয়েও সুন্দর। এক্কালে ডানাকাটা পরি।

এ শুনে মিজান সাহেব আফসোস্ করেন- ইস্, কেন্ যে ঐ লাইনে গেলাম না।

চল্লি­শোর্ধ বয়সের একজন মানুষের মুখে এমন বেমানান আফসোস শুনে মবিন মুহূর্তেই তার মাথা ব্যথার কথা ভুলে যায়।

হাল্কা রসিকতা করে- মিজান সাব আফসোস কইরেন না। পরকালে এর চেয়েও অনেক সুন্দর সুন্দর হুর অপেক্ষা করতেছে। মিজান সাহেব স্বাভাবিকের চেয়েও একটু দীর্ঘতর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন- তা কি আর আমাগো ভাগ্যে আছে! এই দুনিয়ায় যে হারে পাপ করতেছি তাতে হুর তো দূরের কতা জাহান্নামের আগুন থেকে কেমনে বাঁচমু হেইডা ভাবতাছি।


মবিন নিজের দক্ষতায় মুগ্ধ। মিজান সাহেবকে সে অতি সফলভাবে সাধারণ টিভি নাটকের ভাবনা থেকে বের করে পরকালের মহা চিন্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার মুখের এই আফসোস এখন আর মবিনের কাছে বেমানান মনে হচ্ছে না। সে মিজান সাহেবের চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে একবার তাকায়। তারপর আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাতের মোমটি জ্বালিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। 


মবিন দরজার বাইরে বের হতেই শোনে মেস সুপার সোলেমান মিয়ার কন্ঠ। এই লোকটা প্রথমদিন থেকেই কেন জানি তার ওপর অকারণে বিরক্ত। তাকে দেখলেই লোকটা কেমন মুখ ফুলিয়ে থাকে। সহজ ভাবে কথাও বলে না। আর তার সামনে বসে কেউ যদি তাকে ডাইরেক্টর সাব বলে- তাহলেই হয়েছে। ফুলে থাকা মুখটা আরেকটু ফুলে উঠে পটকা মাছের আকার ধারণ করে। মবিনের মাঝে মাঝে মনে হয়, লোকটা বোধ হয় জেলাস ফিল করে। কিন্তু সে এর যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পায় না। তাই ব্যাপারটা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায় না।

বাইরে এসে মবিন শুনতে পায়- সুলেমান সাহেব অন্যদেরকে বলছেন- দেখলেন তো দেমাগ কি! বেটা ক্যামেরাম্যানের হেলপার আর চলে যেন এক্কেবারে স্টার।


সুলেমান সাহেবের এরূপ তথ্যের অথেনটিসিটি নিয়ে যখন রুমের ভেতর মোটামুটি একটা ডিবেট শুরু হয়ে গেছে মবিন তখন নীরবে তার রুমের দিকে পা বাড়ায়। মাথাটা এখনও ব্যথা করছে। তবে ঝিমঝিম নয় চিনচিন করছে। মাথার ভেতরে এখনও ঘুরছে অপি করিমের ভাবনা। ভাবতে ভাবতেই সে হঠাৎ দেখে দেয়ালের ছোট ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে করিডরে পড়ছে। মবিনের ইচ্ছে করে চাঁদের আলোটাকে হাত দিয়ে ধরতে। কিন্তু তার সাহস হয় না। তবু সে ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ায়। কিন্তু হাত মুঠোবন্দি করতেই দেখে চাঁদের আলো বাইরেই রয়ে গেছে। সে আবার হাত বাড়ায়। এভাবে কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টার পরে হঠাৎ তার ভেতরে একটা উপলব্ধি আসে। ভাবে, আকাশের চাঁদকে নিয়ে কবি যতই মাতামাতি করুন না কেন- সে চাঁদ যখন আকাশে উঠে সে আর কবির একার থাকে না। সে তখন সবার হয়ে যায়। ভাবতেই মবিনের বুক ভেঙে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।





Comments: