অপ্রাসঙ্গিক

অপ্রাসঙ্গিক

সোহেল মাহরুফ


আজ অনেকদিন পরে রাহুল ঢাকা শহরে- প্রায় নয় বছর। শহরটা বেশ বদলে গেছে। নিউইয়র্কের সাথে বেশ একটা পার্থক্য খুঁজে পায় না। যদিও পার্থক্য অনেক। তবুও রাহুলের কাছে বাহ্যত একই মনে হচ্ছে। রাস্তায় হলুদ ট্যাক্সি ক্যাব, কিছুদূর পর পর ফার্ষ্টফুড এর দোকান, বড় বড় শপিং মল, গগনচুম্বী ভবন- এ যেন খোদ নিউইয়র্ক শহরেই সে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সে বাইশ ঘন্টা আগে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। সে যে ঢাকার শহরে তা প্রথম টের পেলো লম্বা যানজটে পড়ে। আসলে দেশের খবর নিয়মিত না রাখলেও এখান থেকে যাওয়া মানুষদের মুখে প্রথম যে কথাটা শুনতো তা হলো- বাপরে ঢাকার শহরের যানজট! সুতরাং, সে যে ঢাকা শহরে আছে- যানজটে পড়ে তাতে আর কোন সন্দেহ রইলো না। পাশে তার খালু রকিবুল ইসলাম এবং খালাতো ভাই নিয়ন বসে আছে। তারা তেমন কথাবার্তা বলছে না- আড়চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। এ মুহূর্তে তারা যতটা না কথা বলতে চাচ্ছে তার চেয়ে বেশি শুনতে চাচ্ছে। কিন্তু রাহুল তেমন একটা ইন্টারেস্ট পাচ্ছে না। তার মনে পড়ছে সেই বার- তের বছর আগেকার কথা। তখনও এই ঢাকা শহর তার কাছে নূতনের মত ছিল। সবকিছুই কেমন আজব আজব ঠেকতো।


তখন তার বয়স কতই বা হবে। সবেমাত্র দশম শ্রেণিতে উঠেছে। সে সময় তার মা তাকে অকূলে ভাসিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন। তখন তার ছোট খালা বোনের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতেই যেন তাকে ঢাকায় নিয়ে এলেন। তিনি বোনের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখলেন ঠিকই তবে বোনকে দেয়া প্রতিশ্রুতি কতটুকু রাখতে পেরেছেন তা তিনিই ভালো জানেন। আর রাহুল যেটুকু জানে তা হলো তার সবসময় মনে হতো নরকের জীবনও বোধ হয় এর চেয়ে খারাপ হতে পারে না। আর চারপাশের সবার আচরণ দেখে ভাবত এরা কি মানুষ না অন্য কিছু। সে ব্যাপারে তার আজ কোন অভিযোগ নেই। শুধু দুঃখ লাগে এই ভেবে যে দুঃসময়ে কাছের মানুষদের কাছে পায়নি।


এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ প্রশ্ন করে-রুহীর খবর কি?

কার উদ্দেশে প্রশ্ন করা হয়েছে সেটা পরিষ্কার না হলেও রকিব সাহেব এবং নিয়ন প্রায় একইসঙ্গে উত্তর দেয়- ভালো। ভালো ।

রাহুল একবার আড়চোখে তাদের দিকে তাকায়। চোখে চোখ পাড়তেই দু’জনেই থতমত খেয়ে যায়। রাহুল আবার প্রশ্ন করে- সে এখন কি করছে?

রকিব সহেব ব্যস্তভাবে উত্তর দেন- এই তো ইংলিশে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। আপাতত আর কিছু করছে না।

কথার খাতিরে কথা বলার জন্যেই রাহুল অবাক হওয়ার ভান করে- কিছ্ছু না! একেবারে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে?

রকিব সাহেব রাহুলের এমন উদ্বেগ দেখে নিজেই বেকুব বনে যান। আমতা আমতা করে বলতে থাকেন- না মানে এখন পর্যন্ত সে রকম কিছু ভেবে উঠতে পারেনি।


সূত্রমতে এখন রাহুলের উচিৎ তার উদ্বেগের মাত্রা আরেকটু বাড়িয়ে দেয়া এবং সাথে সাথে লাইফ প্লানিং এবং কেরিয়ার প্লানিং সম্বন্ধে ওয়েস্টার্ন লোকদের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে নছিহত করা। সচারাচর সবাই বাইরে থেকে এসে প্রথম প্রথম এমনটিই করে। কিন্তু রাহুল আর আগ্রহ পাচ্ছে না। সে- ‘ওহ্ আচ্ছা’ বলে বাইরের দিকে তাকায়। ভাবে খালার খবর কিংবা আর কারো খবর জিজ্ঞেস না করে হঠাৎ রুহীর খবর জিজ্ঞেস করাটা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে। কিন্তু সে তো মনে মনে জানে ব্যাপারটা আসলে কতটা প্রাসঙ্গিক। 


সেই যেদিন থেকে বুদ্ধি হয়েছে সেদিন থেকেই তো সে বুকের মধ্যে একটা ছবি লালন করে আসছে। আর তা হলো রুহীর ছবি। হঠাৎ সে কথা মনে পড়তেই রাহুল উদাস হয়ে যায়। অবাক হয়ে ভাবে সেইসব দিনের কথা। সেই কবে একবার রুহী তাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। তখন রাহুলের বয়স আর কতই বা হবে! নয়- দশ বছরের নিতান্ত এক বালক। রুহীর বয়সও সেরকমই ছিল। ভালোবাসাটাসা কি জিনিস তা তারা কেউই জানতো না। তবুও সে রুহীর জন্যে কি করেনি সেদিন? আজ সেসব ভাবতেও তার হাসি পাচ্ছে। সেই সারাক্ষণ রুহীকে চোখে চোখে রাখা যাতে না আবার পাশের বাড়ির কালো কুকুরটা দেখে ভয় পায় অথবা পুকুর ধারে গিয়ে না আবার পানিতে পড়ে যায়। তার চোখের সামনে আজ সবকিছু ছবির মতো ভাসছে। যে রাহুলকে সকালে ঘুম থেকে তুলে মক্তবে পাঠাতে পুরো পাড়া খবর হয়ে যেতো-সেই রাহুলই আঁধার কেটে যাওয়ার আগেই ঘুম থেকে উঠতো। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়- পাশের বাড়ির এক কাকার শখের ফুলবাগান থেকে ফুল চুরি করা। রুহীকে দেয়ার জন্য। কত রংবেরং এর ফুল ছিল সেই বাগানে- সে সেগুলোর নামও জানতো না। যেদিন যে রং এর ফুল ভালো লাগতো সেদিন সেটি নিয়ে আসতো। কিন্তু রুহীর শিশুতোষ চোখে কোন ফুলই সুন্দর লাগতো না। সে প্রতিদিনই ফুল এনে দিতো আর রুহী ‘কি নোংরা, কি গন্ধ বলে’ ছুড়ে ফেলতো। আর এ দেখে তার বুক ভেঙে যেতো। তবুও পরেরদিন সে নূতন রঙের ফুল নিয়ে হাজির হতো আর পুরানো যন্ত্রণাতেই বুক ভরাতো। একদিন তো ধরাই পড়ে গিয়েছিল সেই কাকার হাতে। তেত্রিশবার কানে ধরে উঠা বসা করে শেষে ছাড়া পেয়েছে। তবুও সে রুহীকে খুশি করতে পারেনি। আরেকদিনের কথা- হঠাৎ রুহীর চোখ পড়েছে তাদের উঠানের পেয়ারা গাছের পেয়ারার দিকে। পেয়ারা তার চাই ই চাই। রাহুল ভাবলো রুহীকে খুশি করার এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। যদিও সে গাছে চড়তে জানতো না- তবুও আত্মবিশ্বাসের সাথেই বললো- দাঁড়াও, এক্ষুনি এনে দিচ্ছি। সে কাঁপা কাঁপা পায়ে গাছে উঠার জন্যে পা বাড়ায়। শুকনো ডালে লেগে তার শরীরের এখানে ওখানে ছিঁড়ে গিয়ে সেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল। কষ্টে তার চোখে জল চলে আসে। তবু সে গাছ থেকে পেয়ারা নিয়ে নামে। রুহী যাতে তার চোখের জল দেখতে না পায় সে জন্যে সে আরেক দিকে তাকিয়েই রুহীর হাতে তা তুলে দিয়েছিলো। আর রুহী তার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের জ্ঞান জাহির করার জন্যেই ছোট করে বললো- থ্যাঙ্ক য়্যু। ঘটনাটা মনে পড়তেই রাহুল তার বুকের একপাশে সেদিনের সেই ব্যথাটা অনুভব করলো। আরও কত বিক্ষিপ্ত ঘটনা যে মনে পড়ছে তার ইয়ত্তা নেই। সেই একদিন গাঁয়ের পথে হাঁটতে গিয়ে রুহী হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলো। তখন তার মনে হয়েছিল রুহী নয় যেন সে নিজেই পড়ে গেছে। পুরো ব্যথাটাই যেন তার গায়ে লেগেছিল। সে দৌড়ে যায় রুহীকে তোলার জন্যে। কিন্তু রুহীর অহংকারী প্রতিবাদ- ইস্! তোমার ঐ নোংরা হাত ধরবো! কক্ষনো না।

সেদিন তার মনে হয়েছিল এ পৃথিবী তার জন্যে না, এ আলোতে সে আর মুখ দেখাতে পারবে না। তার তখন ইচ্ছে করছিলো মাটির নিচে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে।


রাহুল অবাক হয়ে যায়। এসব সেই কবেকার কথা তবু এখনও তার চোখের সামনে ছবির মত দৃশ্যমান। ভাবে এসব ছোট ছোট ছেলেমানুষী, ছোট ছোট কষ্টগুলো কত মজার, কত রোমাঞ্চকরই না ছিল। কিন্তু তখন এসব কিছুই বুঝতে পারেনি। আজ এই এত বছর পরে তার ইচ্ছে করছে আবার সেইসব দিনের মধ্যে হারিয়ে যেতে। সে কল্পনাতে সত্যি সত্যিই সেসব দিনের মধ্যে হারিয়ে যায়। সেইসব ছেলেমানুষীর কথা ভেবে এখন শুধু হাসিই পায়। মনে পড়ে- ছোটবেলা সে দাদির কাছে গল্প শুনতো। দাদি একদিন বলেছিলেন- পৃথিবীতে পুণ্য করলে পরকালে বেহেশত পাওয়া যায়। সেইখানে দুধের নদী আছে, ফলমূলের গাছ আছে আর আছে হুর। সেখানে মানুষ যা চায় তা ই পায়।

রাহুল সবই বোঝে কিন্তু তার খটকা লাগে হুর নিয়ে। তাই তার সরাসরি প্রশ্ন- দাদি হুর কি?

-হুর হইলো সোন্দর সোন্দর পরি- দাদির সহজ উত্তর। কিন্তু রাহুল তত সহজে বোঝে না।

সে জিজ্ঞেস করে- দাদি, হুর দেখতে কেমন?

নাতির উপর্যুপরি প্রশ্নে দাদি বিরক্ত। তিনি বুঝতে পারেন না বালকের প্রশ্নের আসল উদ্দেশ্য। তাই তিনি তার মত  করেই জবাব দেন- হুর আবার দেখতে কেমন হইবো- হুরের মতন।

সেদিন রাহুল এমন উত্তরে সন্তুষ্ট হয়নি। সে তার মতো করেই উত্তর সাজিয়ে নেয়। ভাবে হুর দেখতে রুহীর মতোই হবে। আর যদি তার মতো না- ই হয় তবে তার বেহেশতের হুর চাই না রুহীকেই চাই।


হঠাৎ গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যালে পড়েছে। সেটা রাহুলের কাছে স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। কিন্তু যে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে তা হলো- গাড়ি থামার সাথে সাথেই বেশ কয়েকটা ছেলেমেয়ে জানালার কাছে ভিড় জমিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য কি বুঝতে না পারায় সে কিছুটা ভড়কে গেছে। রকিব সাহেব যেন তার এই কৌতূহলী মুখটাই আশা করছিলেন। তাই সে মুখ ফেরাতেই তাকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন না। আগ বাড়িয়েই বললেন- আরে বলো না! ছোটবেলা একটা কবিতা পড়েছিলাম যে- দিনে মশা রাতে মাছি/ এই নিয়ে কলকাতায় আছি। এখন ঢাকার শহরে আমরা এরকমই আছি। মশা, লোডশেডিং, আবর্জনা, ট্রাফিক জ্যাম- তার উপর আবার এই নতুন উৎপাত। কোন রকম ট্রাফিক সিগন্যাল পড়লেই হলো- গাড়ির চারপাশে এমনভাবে ভিড় করে না- দেখলে গা গিজগিজ করে।

-এরা কি চায়? ভিক্ষা?

-আরে না, না, এরা ফুল বিক্রি করে। আর বলো না দুপুর সকাল আর সন্ধ্যা নাই। সবসময়ই এরা আছে। আরে ফুল যখন লাগবে তখন তো দোকান থেকেই কিনে নিতে পারবো। আর অফিসে যাওয়ার সময়ে ফুল কিনেই বা কি হবে? কিন্তু তারপরও এরা উৎপাত করবে। কানের কাছে এসে ঘ্যানর ঘ্যানর করবে- স্যার একটা ফুল নেন না, স্যার একটা মালা নেন না বলে।


রাহুলের আবার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। একদিন একজনকে ফুল দিয়েও তার মুখের হাসি দেখতে পারেনি অথচ আজ কয়েকটি টাকার বিনিময়ে ফুল নিলেই এদের মুখে হাসি ফুটবে। ব্যাপারটি মাথায় আসতেই সে আর কিছু চিন্তা না করে গাড়ির গ্লাস নামানোর জন্যে হাত বাড়ায়।

-আরে করো কি, করো কি- বলে একপ্রকার তেড়ে এসেই রকিব সাহেব তাকে গ্লাস নামানো থেকে নিরস্ত করেন।

রাহুল ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে যায়। হা করে তাকিয়ে থাকে রকিব সাহেবের দিকে। রকিব সাহেব কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন- কি করছিলে তুমি? জানো এরা কতটা ডেঞ্জারাস? এদের বিরাট গ্যাং আছে। একজনের কাছে থেকে কিনবে তো সবাই এসে ভিড় করবে। তখন যানজট আর জনজট মিলে এমন এক অবস্থা হবে যে আজকে আর এখান থেকে বাসায় যেতে হবে না।


রাহুল শান্তভাবে একবার রকিব সাহেবের দিকে তাকায়। তারপর ফিরে গ্লাস নামানোর উদ্যোগ নিতেই সবুজ বাতি জ্বলে উঠে। গাড়ি সামনে এগোয়। রাহুলের মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। বদলে যাওয়া ঢাকাকে দেখতে থাকে। দেখতে দেখতেই মনে পড়ে সেইসব কথা- সেই ঢাকায় থাকার দিনগুলোর কথা। মনে পড়ে- মা মারা যাওয়ার মাস দুয়েকের মাথায় সে ঢাকায় আসে। আর প্রথম যখন ঢাকায় পা রাখে তখন তার মনে হয়েছিল তার জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই। এতদিন ধরে যাকে চেয়ে এসেছে এখন সে সারাক্ষণই তার পাশে থাকবে। চব্বিশ ঘন্টা। কিন্তু পরেরদিন সকালেই তার ভুল ভাঙলো-  রকিব সাহেব, রুহী, নিয়নদের ব্যবহারে। কিন্তু সে সেটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয়। ভাবে তারা শহরের মানুষ- এরকম একটু আধটু দুর্ব্যবহার তারা করতেই পারেন। কিন্তু তার শেষ ভরসা তার খালার কাছে থেকেও একই রকম ব্যবহার পাওয়ার পরে তার ভুল ভাঙে। তার কাছে তখন নিজের জীবনটাকে দুর্বিষহ মনে হতে লাগলো। তার তখন নিজের কাছে নিজেকে মনে হতো রুহীদের পোষা কুকুরটার চেয়েও নিচ কোনো প্রাণী। সেই কুকুরটার কথা মনে পড়তেই রাহুলের একদিনকার ঘটনা মনে পড়ে গেলো। যে ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। ঘটনাটা মনে পড়তেই রাহুল হঠাৎ রকিব সাহেবকে জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা খালু, রুহীর কুকুরটার খবর কি?

এ প্রশ্নে রকিব সাহেব বিরক্ত বোধ করেন। মনে মনে ভাবেন বিদেশ থেকে এসে সবাই প্রথমে জানতে চায় দেশের রাজনীতির কথা, খাওয়া দাওয়ার কথা, আবহাওয়া পরিবেশ দূষণের মাত্রা ইত্যাদি। কিন্তু এ ছেলে তো আজব। তারপরে নিজেই নিজেকে বুঝান- ঐ উদ্ভট আমেরিকানদের সাথে এতদিন একসাথে থাকতে থাকতেই তার এই অবস্থা হয়েছে। তাই তিনি নিজের স্পষ্ট বিরক্তিকে লুকিয়ে প্রশ্নের জবাব দেন- ও ও মিট্টি, মিট্টির কথা বলছো? ওটাতো দুই তিন বছর আগে মারা গেছে।


রাহুল আর কিছু না বলে আবার বাইরের দিকে তাকায়। ভাবে সেদিনের সেই ঘটনার কথা। ঢাকায় এসেছে তখন তিন চার বছর হয়ে গেছে। সে তখন ঢাকা কলেজে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। জীবনের অনেক অলিগলি তখন তার চেনা হয়ে গেছে। সেই দুর্বিষহ জীবনের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ করেই সে তখনও তার খালার বাসায়ই থাকতো। যাকে বলে একেবারে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা। কেননা সে তখনও ভাবত একদিন না হয় একদিন রুহী বুঝতে শিখবে। আর সেদিন তার ভুল ভাঙবে। আর তখন সে ঠিকই তাকে মেনে নেবে। ঠিক যেমনটি হয় সিনেমা- নাটকে। কিন্তু বাস্তবতা তো আর সিনেমা নাটক নয় তাই রুহীর ভুল ভাঙ্গার আগে তার নিজের ভুলই ভাঙলো।


রুহীদের বাসার কুকুরটার ওপর প্রথমদিন থেকেই তার কেমন একটা চাপা ক্ষোভ ছিল। মনে মনে ভাবতো, ‘শালার একটা পশু হয়েও এত আদর যত্ন পাচ্ছিস! এর চার ভাগের এক ভাগও যদি পেতাম।’ সেদিন ছিল বন্ধের দিন। সে স্রেফ রুহীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই কুকুরটার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে যাচ্ছিল। তখন রুহী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায়- তোর ঐ নোংরা হাত দিয়ে মিট্টিকে ছুঁবি না বলছি। বলেই ছোঁ মেরে কুকুরটাকে তার কোলে তুলে নেয়। রাহুল তখন আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। কুকুরটাকে রুহীর কোল থেকে টেনে নিয়ে মারলো এক আছাড়। তারপর যা হবার তাই হলো। রুহীতো কেঁদে কেটে একাকার। বাসায় স্পেশাল পশু ডাক্তার টাক্তার এনে এক অবস্থা। আর এর ফাঁকে খালা, খালু যা বললো তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ইভেন এই নিয়ন ছেলেটা। সেদিন কতটুকুই বা ছিল। ক্লাস সেভেনে না এইটে পড়তো। সেও বলতে বাদ রাখেনি। তখন অপমানে রাহুলের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যেন পেট থেকে বের হয়ে আসতে চাইছিল।


সবাই যখন মিট্টিকে নিয়ে ব্যস্ত তখন সে কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়- আর ফিরবে না এই প্রতিজ্ঞা করে। এক পোশাকেই সে বাসা থেকে বের হয়। সারাটা দুপুর সে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করে কাটায়। কোথায় যাবে, কি করবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বৃটিশ কাউন্সিলের দিকে যায়। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই সে বৃটিশ কাউন্সিলের মেম্বার হয়েছিল। সেদিন উদ্দেশ্যহীনভাবেই সে বৃটিশ কাউন্সিলের ভেতরে ঢুকে পড়ে। সেখানে তার সাথে দেখা হয় মি. পিটারসনের। আমেরিকান ভদ্রলোক। কি একটা রিসার্চের কাজে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আগে থেকেই তার সাথে রাহুলের পরিচয় ছিল। প্রথমদিকে যখন সে বৃটিশ কাউন্সিলে যেতো তখনই একদিন তিনি নিজের থেকেই এসে তার পাশে বসেছিলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলেছিলেন- এক্সকিউজ মি, আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।

রাহুল কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে বলে ফেলে- ওহ্ সিওর সিওর। প্লিজ টেল।

লোকটা তখন তাকে অবাক করে দিয়েই জিজ্ঞেস করলেন- তুমি একা?

রাহুল একজন অপরিচিত বিদেশির এমন প্রশ্নের মানে বোঝে না। সে কিছুটা ভড়কে যায়। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে- জ্বী, মানে?

বিদেশি তার নিজের এমন সরাসরি প্রশ্নে তিনি নিজেই বিব্রত। তাই তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন- না মানে আমি জানতে চাচ্ছিলাম- তোমার মা বাবা কোথায়?

-তারা কেউ বেঁচে নেই।

রাহুলের এ জবাব শুনে তিনি বললেন- আমি এমনটিই অনুমান করেছিলাম।

রাহুল অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাহুলের বিস্ময় ভাঙাতেই যেন তিনি হাত বাড়িয়ে দেন- আই অ্যাম পিটারসন- মাইক পিটারসন।

রাহুলও সৌজন্যতার খাতিরেই বলে- আমি রাহুল। কিন্তু তারপর আর বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পায় না। 

তখন মি. পিটারসন তার এভাবে গায়ে পড়ে এসে এ প্রশ্ন করার কারণ ব্যাখ্যা করার মত করেই বললেন- আসলে আমিও একা তো- তাই একাকী কাউকে দেখলে সহজেই বুঝতে পারি।


তখনও লোকটিকে রাহুলের কাছে সন্দেহজনকই মনে হচ্ছিল। কিন্তু পিটারসনেরই একপাক্ষিক প্রচেষ্টায় সেই সন্দেহ দূর হয়। ধীরে ধীরে তাদের ভেতর একটা অন্যরকম মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পিটারসনের ফ্ল্যাটের দরজা রাহুলের জন্যে উন্মুক্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সেখানে অবাধ হয় রাহুলের আনাগোনা। ধীরে ধীরে জানতে পারে এই সফেদ সাদা চুলের এই সদা হাসিখুশিময় বৃদ্ধটির ভেতরে লুকিয়ে আছে কি এক অন্ধকার। জানতে পারে তার জীবনের আদি অন্ত...


পিটারসনের বয়স যখন ছয় বছর তখন তার মা তার বাবাকে ছেড়ে যান। তার বাবা তাকে নিজের কাছে রেখে দেন। কিন্তু কিছুদিন পার হতে না হতেই তিনি আরেকটি বিয়ে করেন। আর পিটারসনকে রেখে দেন তার দাদা দাদির জিম্মায়। সেখানেই সে বড় হতে থাকে। তারপর একসময় তারাও একে একে পাড়ি দেন পরপারে। তখন থেকেই পিটারসন মুক্ত স্বাধীন। আর তার এই স্বাধীন জীবনে তার দাদা দাদির রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি তার উচ্ছন্নে যাওয়ার জন্যে যথেষ্টই ছিল। কিন্তু পিটারসন ছিলেন অন্যরকম। মুক্ত জীবনে গা ভাসিয়ে দেয়ার মত মানসিকতা তার কখনই ছিল না। তিনি সবসময়ই সুখ খুঁজতেন একটি ছোট ঘর- ছিমছাম, সাজানো গোছানো জীবনের মধ্যে। একদিন তিনি তার সেই সুখের ঠিকানা খুঁজেও পেলেন- এক তরুণীর চোখে। ভালোবেসে ফেললেন তাকে। বিয়েও করলেন। পাতলেন ছিমছাম সুখের ঘর। সেই ঘরে আলো হয়ে এলো লুসি- তার একমাত্র মেয়ে। কিন্তু তারপরই আবার সেই ভাঙন। লুসিকে তার কাছে রেখে তার মা চলে গেলো। চিরকালের ঘর খুঁজে মরা পিটারসন আর বিয়ে করলেন না। মেয়েকে নিয়েই সাজালেন তার ছোট্ট সুখের ঘর। সেই মেয়েও একদিন বড় হলো। সবকিছু বুঝতে শিখলো। তারপর সেও চলে গেলো তার মায়ের কাছে। তারপর থেকে একা একাই আছেন। একদিন তিনি কি এক প্রসঙ্গে বলছিলেন- রাহুল আমার কেন জানি মনে হচ্ছে- আমার কোন পূর্ব পুরুষ এশিয়ান ছিলেন। আমার ভেতর যেন এশিয়ানদের রক্ত বইছে। আমি সবসময়ই কেন জানি চেয়েছি- বাবা মা সন্তান সবাইকে নিয়ে এক ছাদের নিচে একসাথে থাকতে। কিন্তু ওখানে তা হবার নয়।


রাহুল এর জবাবে বলার মতো কিছু খুঁজে পায়নি। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। পরে আরো পরে একদিন বুঝেছিল এই লোকটির ভেতরে কি পরিমাণ বাৎসল্য কাজ করছে।  সেদিন ক্লাস শেষে করিডরে দাঁড়াতেই দেখতে পায় গেটের বাইরে পিটারসনের লাল টয়োটা গাড়ি। আর রোদের ভেতরে হ্যাট মাথায় দিয়ে তিনি গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখেই তিনি হ্যাট নেড়ে নিচে নামার জন্যে ইশারা করলেন। নিচে নামতেই বললেন- আমার সাথে চল। আজ আমার ওখানে খাবে। স্পেশাল ডিশ হয়েছে।

রাহুল ভদ্র ছেলের মতো গাড়িতে উঠে বসে- এ্যানি অকেশন?

-ইয়েস! ইয়েস! গেলেই জানতে পারবে।

রাহুল আর কোনো কথা বলে না। পিটারসন সাহেব পথ থেকে একটা বেশ বড় সাইজের কেক নেন। মনে হচ্ছিল আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছিলেন। তারপর বাসায় ফিরে খাওয়া দাওয়া হল। কিন্তু তখনও সে জানত না অকেশনটা কি? যখন মোমটোম দিয়ে সাজিয়ে কেকটি আনা হলো কাটার জন্যে তখনই জানা গেল অকেশনটা কি। আসলে সেদিন ছিল পিটারসন সাহেবের মেয়ে লুসির জন্মদিন। পিটারসন সাহেব বেশ হৈ চৈ করে কেক কাটলেন। তারপর হঠাৎ বিষন্ন মুখ নিয়ে এসে রাহুলের পাশে বসলেন। হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে উঠলেন- আচ্ছা তোমরা তো এখানে ডেডিকে বাবা বলে ডাকো, তাই না?

রাহুল এমন প্রশ্নের কারণ বুঝতে পারল না। সে জবাব দিল- জ্বী।

তখন তিনি রাহুলের জন্য মন খারাপ হওয়ার মতন একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। জিজ্ঞেস করলেন- রাহুল তোমার বাবা কখন মারা গেছেন?

রাহুলের চোখ তখন টলটল করে উঠে। সে জবাব দেয়- সে অনেক আগে। তখন আমি ক্লাস টুতে পড়ি।

পিটারসন সাহেব রাহুলের আরেকটু কাছে ঘেঁষে বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন- তোমার কখনও কি তার কথা মনে পড়ে না? কখনও কি বাবা ডাকতে ইচ্ছে করে না?

রাহুল কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জবাব দেয়- হ্যাঁ করে। মাঝে মাঝে রাতের আঁধারে একা একা শুয়ে শুয়ে বাবাকে ডাকি। তার সাথে কথা বলি।

এরপর পিটারসন সাহেব কেমন যেন নার্ভাস হয়ে পড়েন। রাহুলের চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলেন- তুমি কি আমাকে একবার বাবা বলে ডাকবে? বলেই তিনি রাহুলের হাত দু’টি চেপে ধরেন।


একথা শুনে রাহুল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। পিটারসন সাহেবকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কতক্ষণ এভাবে কেঁদেছিলো তা আর আজ রাহুলের মনে নেই। তবে তার এইটুকু মনে আছে যে সে চোখ মুছে পিটারসন সাহেবকে বলেছিলো- আপনি তো আমার বাবার মতোই। আপনার স্নেহ দেখে আমার শুধু বাবার কথাই মনে পড়ে। তার কথা আমার পুরোপুরি মনে নেই। কিন্তু আপনার কাছে আসলেই আমার মনে হয় আমার বাবা বোধ হয় এমনই ছিলেন। তাই যখনই খুব খারাপ লাগে- খুব করে বাবার কথা মনে পড়ে তখনইতো আপনার কাছে চলে আসি।


এ কথাগুলো যে সেদিন কোথা থেকে রাহুলের মুখে এসেছিলো তা রাহুল আজও জানে না। তবে সেদিন সে জেনেছিলো একজন বাবার হৃদয়ে কতটা হাহাকার থাকে সন্তানের মুখে বাবা ডাক শোনার জন্য। পিটারসন সাহেব তার এই কথাগুলো শুনে বলেছিলেন- থ্যাঙ্ক য়্যু মাই চাইল্ড! থ্যাঙ্ক য়্যু! ফ্রম নাউ ইউ আর মাই সান। নেক্সট টাইম আই উইল সেলিব্রেট ইউর বার্থডে নট লুসি’স। তারপর দু’জনেই দু’জনকে জড়িয়ে ধরে থাকল অনেকক্ষণ। সেদিন থেকে পিটারসন সাহেবের ফ্ল্যাটের একটা চাবি রাহুলের হাতে চলে এলো। তার যখন খুশি সেখানে চলে যেত। ফ্রিজ খুলে ইচ্ছেমত খেয়েদেয়ে চলে আসত। মাঝে মাঝে যখন খালার বাসার বিরুদ্ধ পরিবেশে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত তখন সে পিটারসন সাহেবের কাছে ছুটে যেত। তার কোলে মাথা রেখে শুলেই সে তার সব কষ্টের কথা ভুলে যেত। কতদিন তিনি তার কষ্টের কথা শুনতে চাইতেন। কিন্তু সে কখনও বলেনি। ভাবত হয়তো তিনি শুনলে তার চেয়েও বেশি কষ্ট পাবেন। তারপরও তিনি নাছোড়বান্দার মতো বারবার শুনতে চাইতেন। শেষমেশ তিনি তাকে তার কাছে রেখে দিতে চাইতেন। কিন্তু সে শুধু রুহীর কথা চিন্তা করে কখনও রাজি হয়নি। আজ সেসব কথা ভাবতেই লোকটার জন্যে ভালোবাসায় তার বুকটা ভরে উঠে।

সেদিন যখন সে বৃটিশ কাউন্সিলে ঢুকলো তখন তার শুকনো মুখ দেখে পিটারসন সাহেব খারাপ কিছুই অনুমান করলেন। জিজ্ঞেস করলেন- কি হয়েছে? তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন?


তার অমন স্নেহমাখা কথা শুনে রাহুলের চোখ টলটল করে উঠলো। সে কিছুই বলতে পারলো না। পিটারসন সাহেবও তাকে আর না ঘাটিয়ে সাথে করে বাসায় নিয়ে গেলেন। রাহুলের আজ মনে হচ্ছে সেদিন তার নিয়তিই তার সাথে পিটারসন সাহেবের দেখা করিয়ে দিয়েছে। নইলে হয়তো তার জীবনের গল্পটা অন্যরকম হত। কেননা সারাটা দুপুর সে পথে পথে হেঁটেছে তবু একবারও তার মনে হয়নি পিটারসন সাহেবের ফ্ল্যাটে যাওয়া যেতে পারে। একবারও তার মনে হয়নি, তার কাছে তার সমস্যার কথা বললে তিনি সমাধান দিতে পারেন। হঠাৎ বৃটিশ কাউন্সিলের সামনে আসতেই কি মনে করে যেন ভেতরে ঢুকে পড়ল। আর সেখানেই দেখা পিটারসন সাহেবের সাথে। আর তারপরের গল্পটা তো সিনেমার মতো। কিংবা সিনেমার চেয়েও বেশি সিনেম্যাটিক।


পিটারসন সাহেব বাসায় গিয়ে তার সব কথা শুনলেন। তারপর তার সব দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। হয়ে গেলেন তার সত্যিকারের পিতা। নিজের কাজ শেষ করার পরেও প্রায় ছয় মাস তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। রাহুল এইচ এস সি পাস করার পরেই তাকে নিয়ে পাড়ি দিলেন নিজের দেশের উদ্দেশ্যে। সেখানে নিয়ে তাকে পরিচয় দিলেন নিজের ছেলে হিসেবে। রাহুল পেলো একজন পিতা এবং সেই সাথে স্বপ্নের মতো একটা জীবন। কিংবা স্বপ্নের চেয়েও অধিক সুন্দর একটা জীবন।


সেসব দিনের কথা ভাবতে ভাবতে রাহুলের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। আরো কত স্মৃতি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেই আমেরিকায় তার প্রথমদিককার কথা। পিটারসন সাহেব সেখানে নিয়ে তাকে ভার্সিটিতে ভর্তি করে দিলেন। শুধু ভার্সিটিতে ভর্তি করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তার সমস্ত কিছুর তদারকির দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। রাহুলের এখনও মনে আছে সেই যখন সে রাত জেগে পড়তো তখন পিটারসন সাহেব তার পাশে বসে থাকতেন। সে ঘুমুলে পরে তিনি শুতে যেতেন। তার বাবাও তার জন্য এতটা করতো কি না তার সন্দেহ হয়। এভাবে করেই সে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলো। তারপর সে যখন এমএস করছে তখন এয়ারক্রাশে পিটারসন সাহেব মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে তিনি যেমন তার ভালোবাসা দিয়ে তাকে অবাক করেছেন তেমনি মৃত্যুর পরও পিতা হিসেবে তার দায়িত্বজ্ঞান দেখে সে অবাক হয়েছে। মৃত্যুর আগে তিনি তার লাইফ ইনস্যুরেন্স, ব্যাংক ব্যালান্স সব কিছুতে ওয়ারিশ হিসেবে লুসির পরিবর্তে তার নাম দিয়ে প্রমাণ করলেন তিনি তার জন্মদাতা না হলেও তার সত্যিকারের পিতা ছিলেন। শুধু এইটুকু করেই ক্ষান্ত হননি। তার রিসার্চ ওয়ার্কগুলোর কপিরাইটও রাহুলের নামে। ভাবতেই লোকটার কথা ভেবে ভালোবাসায় তার চোখের কোণা গড়িয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরলো।

পিটারসন সাহেবের মৃত্যুর পরে সবরকমের ট্যাক্স দেয়ার পরও এখনও যে পরিমাণ সম্পত্তি আছে এবং রিসার্চ ওয়ার্কগুলোর রয়্যালটি মানি হিসেবে যা পাচ্ছে তা দিয়ে শুধু রাহুল কেন তার পর আরও দুই চার পুরুষ শুয়ে বসে খেতে পারবে। কিন্তু রাহুল কষ্ট দিয়ে জীবনকে চিনেছে। তাই সে মোটেই শুয়ে বসে কাটানোর পক্ষপাতী নয়। আর তার যা মেধা তাতে এমএস কমপ্লিট করার সাথে সাথেই ভালো চাকরি জোগাড় করে নিতে তার তেমন কষ্ট হয়নি। আর এমন নিশ্চয়তার মাঝে তার নিশ্চিত দিনগুলো বেশ ভালই কাটছিলো। সকাল বিকাল অফিস করা, বন্ধু বান্ধবের বিভিন্ন পার্টিতে এ্যাটেন্ড করা আর মাঝে মাঝে ছুটিতে বিভিন্ন দেশ ঘুরতে বের হওয়া। কিন্তু এমন নিশ্চিন্ত জীবন তার কাছে হঠাৎ একঘেঁয়ে মনে হতে শুরু করলো। তখন মনে হচ্ছিল এভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। হঠাৎ কেন জানি মনে হলো তার একবার পেছনে ফিরে তাকানো উচিৎ। তার অতীত, তার শিকড়ের কাছে ফিরে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু তার সাহসে কুলাচ্ছিলো না। এতদিন পরে গিয়ে কোথায় উঠবে, কার কাছে থাকবে, বদলে যাওয়া পরিবেশের সাথে মানাতে পারবে কি না এসব ভাবতে ভাবতে তার ইচ্ছেটা আর মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস করেনি। তারপর হঠাৎ একদিন কি মনে করে যেন তার খালু রকিব সাহেবের ঠিকানায় মেইল করলো। সে ভাবতেই পারেনি এতদিন পরে এত সহজেই তারা রেসপন্স করবেন। কেননা এখনও তার মনে আছে খালার বাসা ছেড়ে যাওয়ার পর কতদিন সে পত্রিকার নিখোঁজ কিংবা হারানো বিজ্ঞপ্তিগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে- এই ভেবে যে এই বুঝি তারা তার সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলেন। কিন্তু কোনদিনই কোনো কিছু খুঁজে পায়নি। এবার এত তাড়াতাড়ি জবাব দেয়ার কারণ হয়তো ছিল যে চিঠিটা আমেরিকা থেকে এসেছে। চিঠির জবাবে- তাকে ভেবে তাদের অস্থিরতার কথা জানিয়ে, তার সব বিস্তারিত জানতে চেয়ে এবং সে কবে আসতে চায় তা জানিয়ে চিঠি দেয়ার অনুরোধ করে চিঠি দিলেন। এভাবেই তাদের সাথে আবার যোগাযোগ শুরু হলো। তারপর কাগজপত্র সব গুছিয়ে একদিন বিমানে উঠে পড়লো।


পুরনো দিনের সব কথা ভাবতে ভাবত হঠাৎ রাহুলের কি যেন মনে হলো। হঠাৎ রকিব সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো- আচ্ছা খালু এখানে মিডিয়াম কস্টের ভেতরে ভাল মানের হোটেল পাওয়া যাবে তো? এসিটেসি আছে এমন?

রকিব সাহেব এ প্রশ্নে  অবাক হয়ে গেলেন- কেন, কেন, হোটেল কেন?

-না, মানে ড্রাইভারকে সেদিকে যেতে বলেন। আমি হোটেলে উঠবো।

রকিব সাহেব ভাবলেন বাসায় হয়তো তার অসুবিধা হবে ভেবে সে এমনটি বলছে। তাই বাসায় কি রকম আয়োজন তা খুলে বললেন- কেন? বাসায় চলো। বাসায় তোমার কোনো সমস্যা হবে না। তোমার জন্য অ্যাটাচ্ড বাথরুমসহ আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রুমে এসি লাগানো হয়েছে। বাথরুমে গিজার লাগানো হয়েছে।

-না, না সেজন্য না। শুধু শুধু আপনাদের ডিস্টার্ব  করে লাভ কি?

-ডিস্টার্ব বলছো কেন? তুমিতো আমাদের ছেলের মতো। সুতরাং ছেলের জন্য...

রাহুল তাকে কথা শেষ করতে দেয় না। তার আগেই বলে- না মানে হচ্ছে কি, মানে, বাইরে থাকতে থাকতে কিছু বদভ্যাস হয়েছে। মানে...

রকিব সাহেব কি বুঝেছেন কে জানে। রাহুলকে আর তার কথা শেষ করতে হয় না। তিনি বলেন- ওহ্ আচ্ছা, আচ্ছা, তা তুমি যেটা ভালো মনে করো। বলেই ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলেন- হোটেলের উদ্দেশ্যে। রাহুল মনে মনে খুশিই হয়। হোটেলে গিয়েই রকিব সাহেবদেরকে বিদায় দিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে। তারপর গোসল সেরে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। মুহূর্তেই রাজ্যের ঘুম তার চোখে ভিড় করে। মনে হয় যেন কতদিন সে এমন শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি।


ফোনটা একটানা বেজে চলছে। রাহুলের ধরতে ইচ্ছে করে না। একবার বন্ধ হয়ে আবার যখন বাজতে শুরু করেছে তখন রাহুল অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনটা ধরে-  হ্যালো।

-গুডমর্নিং। ভাইয়া আমি নিয়ন বলছি। 

-ওহ্ গুডমর্নিং। কি খবর নিয়ন? কোথা থেকে?

-এইতো। নিচে রিসেপশনে আছি।

-তা নিচে কেন? রুমে চলে আসো।

-না, মানে সাথে রুহী আছে।

-সো হোয়াট! ওকে নিয়েই চলে আসো।

ফোনটা রাখতেই রাহুলের মুখে একটা হাসি খেলে যায়। সে ঝটপট বিছানা ছাড়ে। স্ট্যান্ড থেকে শার্টটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপায়। বেসিনে গিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে মুখ মুছতেই দরজায় শব্দ হয়। রাহুল দরজা খুলতেই দেখে সামনে রুহী দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই রুহী হাত বাড়িয়ে দেয়- হ্যালো রাহুল।


রাহুলের মাথায় হঠাৎ দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায়। সে হাত বাড়িয়ে পাশের টেবিলে রাখা টিস্যুবক্স নিয়ে এগিয়ে দেয়। বুদ্ধিটা হঠাৎ মাথায় আসাতে প্রস্তুতিটা তেমন শক্ত হয়নি। তাই রুহীর অপমানাহত চোখের দিকে তাকানোর সাহস তার হয় না। সে পেছনের দেয়ালে পড়া রুহীর ছায়ার দিকে তাকায়। দেখে অপমানে রুহী থিরথির করে কাঁপছে। নিয়ন কিছু বুঝে উঠার আগেই রুহী তার হাত ধরে টানতে টানতে লিফটের দিকে পা বাড়ায়। রাহুল দেখে রুহীর ছায়া লম্বা হতে হতে আস্তে আস্তে মিশে যায়। তখন একটা অনুশোচনাবোধ তাকে গ্রাস করে। ভাবে, ব্যাপারটা বোধ হয় একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেছে। কেননা তার কপালে যত অপমান, যত দুঃখ কষ্ট লেখা ছিল তা সে ভোগ করেছে। আর তার সুফলও পাচ্ছে। কিন্তু তার জন্য রুহীর সাথে এমন ব্যবহার করা- রুহীকে এভাবে কষ্ট দেয়া উচিত হয়নি। বিশেষ করে এটাতো সত্যি যে এই রুহীই তার এই দীর্ঘ পথ চলায় ভেতরে ভেতরে অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছে। আর এও তো সত্যি যে আজ সে যে বাংলাদেশে এসেছে তারও একমাত্র কারণ তো এই রুহীর কাছেই ফিরে আসা। এসব ভাবতে ভাবতেই রাহুলের খারাপ লাগতে শুরু করে। তারপরও তার কেন জানি মনে হচ্ছে তার সুখের সূর্য আর মেঘের আড়ালে থাকবে না। সে বেরিয়ে আসবেই। তার সোনালি হাসি হাসবেই।




Comments: