প্রতিদানে প্রতিশোধ

প্রতিদানে প্রতিশোধ

সোহেল মাহরুফ


রাত প্রায় বারোটা। কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখার কাজ সারছি। সারাদিন একটুও অবসর নেই। কাজের পর কাজ। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। তবু লিখতে হচ্ছে। বইমেলা নিকটে বলে প্রকাশকরা চাপ দিচ্ছেন লেখাগুলো তাড়াতাড়ি সারার জন্য। একটা উপন্যাস লিখছি। ঘটনার মাঝখানে এসে যখন কলমটা থামালাম ঠিক তখনই টেলিফোনটা বেজে উঠল। বেশ কিছুটা বিরক্তিই বোধ করলাম। একেতো ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে-তার উপর কাজের ভেতরে ডিস্টার্ব। তবু টেলিফোনের রিসিভার তুললাম। ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠে ভেসে এলো- হ্যালো জয় চৌধুরী আছেন?

ওহ্ বলতে ভুলেই গেছি- আমি কিন্তু অবিবাহিত এবং মোটামুটি প্রিয়জনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। সুতরাং এত রাতে একাকী একজন নারীর সাথে আলাপ- মোটামুটি সতেজই বোধ করলাম। তারপর কতক্ষন যে কথা হলো তা বলতে পারবো না। তবে উপন্যাসখানা কোথায় বন্ধ করেছি, নায়কের কি হয়েছে- নায়িকা কোথায় গেছে ততক্ষনে তা ভুলে গেছি। এতক্ষন ধরে তিনি যা বললেন তার সার কথা হচ্ছে- তিনি আমার একজন ভক্ত (প্রকৃতই); আমার লেখার উপমা খুঁজতে গিয়ে তার রাতের ঘুম নষ্ট, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সবশেষে জানালেন ছোট্ট একটা আবদার কিংবা আবেদন। অর্থাৎ তিনি আমার সাথে দেখা করতে চান- কোনো রেস্টুরেন্টে অথবা পার্কে। অবশেষে রেস্টুরেন্টে যাবার সিদ্ধান্তটাই চূড়ান্ত হলো। রেস্টুরেন্টের নাম এবং তিনি কেমন পোশাকে থাকবেন, কোন টেবিলে বসবেন এটা বলে মুক্তি দিলেন। তার এত কথার ফাঁকে আমি শুধুমাত্র দেখা করার সম্মতিটুকুই দিয়েছি। হুঁ হাঁ করা ছাড়া আর কিছু বলিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। রিসিভার রেখে দিতেই মনের ভেতর অন্য ভাব জাগলো। শুনেছি কথা দিয়ে কথা রাখলে মানী লোকের মান থাকে না। তাই ঠিক করলাম তার সাথে দেখা করবো না। কিন্তু কাজের চপে আমি প্রায় বিধ্বস্ত। সুতরাং কিছুটা অবসর খুঁজছিলাম। আর সেই অবসর যদি কাটে কোনো নারীর আলাপের উঞ্চতায়, তবে কি কম কিছু!

এই লোভ সামলাতে না পেরে পরের দিন বিকেল পাঁচটার আগেই তার প্রস্তাবিত রেস্টুরেন্টের উদ্দেশে বের হলাম। রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়াতেই বুকের ভেতরে টিপ টিপ স্পন্দন অনুভব করলাম। রেস্টুরেন্টটায় যে নূতন এসেছি তা কিন্তু নয়। তবুও কেমন যেন মনে হচ্ছিল। ঠিক যেমন মনে হয়েছিল কৈশোরে একটি মেয়েকে দেখে যখন ভেবেছিলাম জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন পেয়েছি;  প্রথম কবিতা লিখে ভেবেছিলাম জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ করেছি কিংবা যখন প্রথম বইটি প্রকাশিত হলো। কেন যে এমন ভাব জাগলো তা বুঝতে পারলাম না (অবশ্য কিছুক্ষন পরেই ব্যাপারটা পরিস্কার হলো)। আমি বেশ স্মার্ট মুডেই ভেতরে প্রবেশ করলাম। রেস্টুরেন্টের কর্ণারে চোখ দিতেই দেখি টেলিফোনের সেই গুণগ্রাহিণী বসে আছেন। দেখে তো আমি থ’। এ যে সেই চোখ, সেই চাহনী- যা একদিন আমার দিনরাতের ধ্যানের বস্তু ছিল।

তখন বাবা মায়ের সাথে চট্টগ্রামে থাকতাম। লেখালেখি তখনও শুরু করিনি। নূতন বাসায় উঠেছি। প্রথম সকালে পত্রিকা নিয়ে বারান্দায় বসতেই চোখ পড়লো সামনের একটি বাসার বারান্দায়। বারান্দাটা আমাদের বাসার দিকেই মুখ করা। বারান্দায় বসা ছিল সে। তাকে এত সুন্দর লাগছিল যে তা উপমায় বুঝানো সম্ভব নয়। সেদিন শুধু অনুভবেই বুঝেছিলাম। মনে পড়লো নজরুলের কবিতা-

“বিজয়ীনি নহ তুমি-নহ ভিখারীনি

তুমি দেবী চির-শুদ্ধ তাপস-কুমারী, তুমি মম চির পূজারিনী।”

ভাবলাম জীবনে সাধনা যদি করতেই হয় তবে এর জন্যেই সাধনা করবো। যখন ঘোর কাটলো দেখি দরজা বন্ধ। এভাবেই শুরু জীবনের এলোমেলো অধ্যায়। ক্লাসের ফার্স্ট বয়, চঞ্চল কিশোর আমি রাতারাতিই বদলে গেলাম। স্কুল-পড়াশুনা সবই প্রায় ছেড়ে দিয়েছি-শুধুমাত্র ওর জন্য। সারাদিনে সে দু’একবার বারান্দায় এসে দাঁড়াতো। আর সেইটুকু সময় দেখার জন্যই আমি সারাদিন বারান্দায় বসে থাকতাম। সবাই যে যার কাজে চলে যেতো শুধু আমি একা বসে থাকতাম-তীর্থের কাকের মতো। সাথী শুধু কতগুলো বই আর একটি টু-ইন-ওয়ান। সময় মোটে কাটতে চাইতো না। তবু বসে থাকতাম- তাকে এক পলক দেখার জন্য। কিন্তু আমাকে দেখলেই সে চলে যেতো। মাঝে মাঝে একটু হাসি দিতো। সে হাসিটা এমনই ছিল যে তার জবাবে আমি কাঁদবো না হাসবো তা বুঝতে পারতাম না। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। অবশেষে চরম মুহূর্ত উপস্থিত। বন্ধুদের পরামর্শে ঢাকাইয়া ছবির হিরো সেজে ওর স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখেই বান্ধবীদের সাথে ওকে বলতে শুনলাম, আমার হ্যাভলা নায়ক এসেছেন- চলতো একটু বাজিয়ে দেখি।

কাছে এসেই একেবারে-কি বলবো! সে মূর্তির বর্ণনা কাগজে কলমে ফুটিয়ে তুলতে গেলে বদনামের সম্ভাবনাই বেশি। মনে হতে পারে লেখকের ভাঁড়ামী। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কেউ যদি নারীর অমন মূর্তি কয়েক মুহূর্তের জন্য অবলোকন করে তবে তার কাছে ঘেষা দুরে থাক সব রোমান্টিক কবিদের মিথ্যুক ভাববে আর উপমার গায়ে থু-থু ছিটাবে। কিন্তু নেড়িকুত্তা বারবার লাথি খেয়েও যেমন পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে আমার অবস্থাও তখন তেমন। 

বারবার অপমানের পরেও আমি তাকে ভালোবাসি। তার জন্যে আমি মজনু সেজেছি। তারপর একদিন ঘোর কাটলো- তার কোমল হাতের একটা নরম চড়ে। 

তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। আজ আমি এই অবস্থানে। অবশ্য এ কথা স্বীকার করতে হবে যে এ অবস্থানে পৌঁছার পেছনে তার চড়টার একটা ভুমিকা আছে বৈকি।

আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে অর্থাৎ তিনি আমার গুণগ্রাহিনী বেশ উৎফুল্ল­ হয়ে উঠলেন- আপনি সত্যিই এসেছেন! আমি নিজেকে এতটা ভাগ্যবতী ভাবতে পারিনি।

আমি শুধু মুচকি হাসলাম (যে একদিন আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে ঘৃণাভরে- আজ আমাকে দেখাটাও তার ভাগ্যের ব্যাপার)।

সেদিন জিদ ধরেছিলাম প্রতিশোধ নেবো-এসিড মেরে ঝলসে দেবো তার মুখশ্রী। কিন্তু সেই অহংকারীনি যখন নিজেই এসে আমার পায়ে আত্মসমর্পন করেছে-এ কি কম প্রতিশোধ!





Comments: