মুখোশের আড়ালে

মুখোশের আড়ালে

সোহেল মাহরুফ

দেশের প্রথম সারির পত্রিকা সপ্নালোক আয়োজিত সুন্দরী প্রতিযোগিতার আজ চূড়ান্ত পর্ব। দেড় হাজার প্রতিযোগির মধ্যে যাচাই বাছাই শেষে চূড়ান্ত দশজন নির্বাচন করা হয়েছে। এর ভেতর থেকেই বের করা হবে একজনকে। তিনিই হবেন এ বছরের সপ্নালোক ফটোজেনিক। এই দশজন ভাগ্যবতীরই একজন হচ্ছে লিপি। সে ভাবতেও পারেনি যে সে এতদূর আসতে পারবে। তবু কীভাবে কীভাবে যেন চলে এসেছে। আজ এই মুহূর্তে সে যতটা আনন্দিত তার চেয়ে বেশি উত্তেজিত। আজ অনেক ভাবনাই তার মনের আয়নায় রেখাপাত করছে। সে যথাসম্ভব সেগুলো ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। চেষ্টা করছে নিজেকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে। এর মাঝেই এক এক করে প্রতিযোগীদের মঞ্চে ডাকা হচ্ছে। উপস্থাপিকা তার সুমিষ্ট কণ্ঠে এক এক করে প্রতিযোগীদের নাম ঘোষণা করছেন আর তারা মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। লিপির নামটা কানে আসতেই তার বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। তবুও সাহসের ওপর ভর করে সে মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ালো। এরপর একে একে বিচারকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। হঠাৎ বিচারকের আসনে একটি নাম শুনে লিপি কেমন যেন হয়ে যায়। পুরনো একটি যন্ত্রণা বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠে। আসলে তিনি আর কেউ নন। তিনি লিপির প্রাক্তন শ্বাশুড়ী-বিশিষ্ট নারী নেত্রী লতিফা বানু। তিনি বসে আছেন একেবারে মাঝের আসনটিতে। তাকে দেখে নিমেষেই লিপির অনেক কিছু মনে পড়ে যায়।

মনে পড়ে সেইসব দিনের কথা। ফেলে আসা দূর্বিষহ জীবনের কথা। মনে পড়ে সে তখন কলেজে পড়তো। তখন থেকেই নিয়মিত র‌্যাম্প করতো সে। আর এ রকম একটা র‌্যাম্প  শোতেই তার সাথে পরিচয় হয় জাভেদ ওয়াহিদের। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ওয়াহিদ জামিল এবং বিশিষ্ট নারী নেত্রী লতিফা বানুর একমাত্র ছেলে জাভেদ। সেই শুরু। তারপর চেনা জানা-ভালো লাগা, ভালোবাসা। তারপর বিয়ে। দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে। সে তখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। মডেলিং কেরিয়ারটাও মোটামুটি গুছিয়ে এনেছিলো। এমন সময় হঠাৎ জাভেদ গো ধরলো যে বিয়েটা এখনই সারতে হবে। কিন্তু পড়াশুনা আর কেরিয়ারের কথা ভেবে লিপি প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু পরে যখন দেখলো জাভেদের সাথে তার একটা ভালো বোঝাপড়া আছে তাই রাজি হয়ে গেলো। ভাবলো বিয়ের পর তেমন কোনো সমস্যা হবে না। এদিকে এই লতিফা বানুও তাকে আশ্বস্ত করলেন। এরপর মহা ধুমধামেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলো। প্রথমেই তিনি মানে তার শ্বাশুড়ী মানে বিশিষ্ট নারী নেত্রী লতিফা বানু তার মডেলিং বন্ধের ব্যবস্থা করলেন। বললেন- ঘরের বউ রাতবিরাতে বাইরে প্রোগ্রাম করতে যাবে সেটা ভালো দেখায় না। আর এটা এমন কোনো জরুরি কিছু না যে না করলেই নয়। তাই এখন ওটা ছেড়ে দেওয়াই উচিত। আর বিয়ের পর এসব লাইনে মেয়েদের ডিমান্ডও তেমন থাকে না।


শ্বাশুড়ীর এই যুক্তিতে শ্বশুর আর হাজব্যান্ড মিলে তার মডেলিং বন্ধের বন্দোবস্ত করলেন। সে কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। শুধু নীরবে কেঁদেছে।


কিন্তু তার শ্বাশুড়ী মানে বেগম লতিফা বানু এখানেই ক্ষান্ত হলেন না। এরপর উদ্যোগ নিলেন তার পড়াশুনা বন্ধ করতে। বললেন- সারাদিন আমাকে বাইরে বাইরে সভা সেমিনারে থাকতে হয়। এদিকে সেও যদি বাইরে থাকে তবে ঘর সামলাবে কে? আর তাহলে ছেলেকে বিয়ে করিয়েই বা লাভটা হলো কী? সুতরাং ভার্সিটি যাওয়াও বন্ধ। যদি একান্তই পরীক্ষা দিতে হয় তবে প্রাইভেট পরীক্ষা দেবে।


অতএব সেরকম ব্যবস্থাই হলো। তাকে  মোটামুটি চারদেয়ালে বন্দি করার ব্যবস্থা করা হলো। সে সবদিক চিন্তা করে সবকিছুই নীরবে সহ্য করতে লাগলো। কিন্তু দিনে দিনে তার এই বন্দি জীবন তার জন্য অসহ্য হয়ে উঠতে লাগলো। আর এভাবে অনেক কষ্টে বছর দুয়েক কাটলো। তারপর ছাড়াছাড়ি।


তারপর আবার সে সবকিছু নূতন করে শুরু করলো। একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ তে ভর্তি হলো। মডেলিংটা আবারও শুরু করলো। তারপর আজ এখানে। এসবকিছু ভাবতে ভাবতেই সে হঠাৎ শোনে উপস্থাপিকা তার নাম ঘোষনা করছে। সে তখন সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাকতালীয়ভাবে তাকে প্রশ্ন করার দায়িত্ব পড়ে বিশিষ্ট নারী নেত্রী লতিফা বানুর উপরে। এটা শুনে লিপি যেন নিজের ভেতর অদ্ভুত এক শক্তি অনুভব করে। 


মনে হলো তার ভেতর যেন সে নেই। আরেক সত্তা তার ওপর ভর করেছে। সে যেন শূন্যে ভাসছে। এর মধ্যে সে শুনতে পায় লতিফা বানু টেনে টেনে বলছেন- আচ্ছা নারী স্বাধীনতা বলতে তুমি কি বুঝো? একথা শুনে তাকে আর উত্তরের জন্য ভাবতে হয় না। তার ভেতর থেকে নিজের অজান্তেই উত্তর বেরিয়ে আসে।

মনে হয় যেন সে নিজে নয় অন্য কেউ তার ভেতরে কথা বলছে। বলে উঠে- নারী স্বাধীনতা মানে নিশ্চয়ই সভা সমাবেশে অকারণ মাইক বাজিয়ে পরিবেশ দূষন নয়- পাঁচতারা হোটেলে গোলটেবিল বৈঠকের নামে পয়সা খরচের রাস্তা বের করা নয়- দেশের পয়সা নষ্ট করে সভা সেমিনারের নামে বিদেশ ভ্রমন নয় কিংবা অনুদানের পয়সা দিয়ে বাড়ির রং কিংবা গাড়ির মডেল বদলানো নয় কিংবা...


এই কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে। তারপর যেন একটু দম নেয়। আবার শুরু করে। তার গলা যেন এবার আরো উচ্চতর হয়- নারী স্বাধীনতা মানে নিশ্চয়ই ঘরের ছেলের বউকে সনাতন বাঙ্গালীয়ানার জন্য চারদেয়ালে বন্দি করা নয় কিংবা নারী পুরুষের দ্বন্ধ সৃষ্টি নয়- বরং...


সে আবার একটু দম নেয়। পুরো অডিটেরিয়াম অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর লতিফা বানুর মাথা নিচু হয়ে যায়। সে আবার বলে- নারী স্বাধীনতা মানে নিশ্চয়ই নারী পুরুষের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করে নারীর পরিপূর্ণ বিকাশ এবং সামর্থ্যের সদ্ব্যবহারকেই বুঝায়।


লিপি এবার আর মানসিক চাপ সহ্য করতে পারে না। সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পরে। লুটিয়ে পরে মঞ্চের উপরে।





Comments: