কাজের ভেতরে ডিস্টার্ব কোনোকালেই অভীকের পছন্দ ছিল না এবং এখনও নয়। তাই মোবাইলটা বেজে উঠতেই তার চোখ কুঁচকে যায়। তবু পরিস্থিতি যেহেতু বাধ্য করছে তাই মানতেই হয়। আর তাই সে এই মুহূর্তে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোবাইলটা তুলে নেয়। নম্বরটা দেখতেই তার বুকের ভেতর কু ঝিকঝিক শুরু হয়ে গেছে। এ যে সেই নম্বর যার কলের জন্য একটা সময় তার দিন কাটতো অপেক্ষায়। সবসময় ভাবতো এই বুঝি কল এলো। আর কল এলেই মনে হতো পুরো পৃথিবীতে ফাগুন এসে গেছে অসময়ে। আজও কেন জানি তার ব্যতিক্রম হলো না। যদিও এমনটি হওয়ার কথা নয়। তবুও সে আজ আবার নম্বরটি দেখার সাথে সাথেই ওপাশের মানুষটির নিঃশ্বাসের উত্তাপও অনুভব করলো। তারপর কীভাবে কীভাবে যেন তার আবেগকে নিয়ন্ত্রন করে ফেললো।
বেশ নিরুত্তাপভাবেই বললো- হ্যালো।
ওপাশ থেকে ভেসে এলো- কেমন আছো?
অভীক নিরুত্তাপ কণ্ঠে জবাব দেয়- যেমনটি চেয়েছো।
ওপাশ থেকে অনুযোগের সুরে-তুমি কি এখনও রেগে আছো?
- না রাগ করার কী আছে?
- তবে এভাবে কথা বলছো কেন?
- কই, কোনভাবে?
- থাক, কোনোভাবে না। শোনো, আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।
- হঠাৎ? কী মনে করে?
- তোমার সাথে কথা আছে।
- আবার কী কথা?
- কেন? তোমার সাথে কি আমার কোনো কথা থাকতে পারে না?
- সেদিনতো সে রকমটাই বলেছিলে।
- ওহ্, তুমি এখনও তা ধরে রেখেছো?
- এখানে ধরাধরির কিছু নেই। শুধু তোমাকে তোমার কথাটাই মনে করিয়ে দিলাম। তা কখন দেখা করতে চাও?
- এই এখনই।
- তাহলে আমার অফিসে চলে এসো।
- ইস্! তোমার ঐ দুই পয়সার এ্যাড ফার্মে! কক্ষনো না! ওখানে কাগজের গন্ধে আমার বমি আসে।
- হিঃ! তুমি আগের মতোই রয়ে গেছো। তা বলো, কোথায় দেখা করতে চাও?
- সেই সেখানে- আমাদের প্রিয় রেস্টুরেন্টটাতে।
- কী দরকার আবার সেই স্মৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার।
- ওহ্ আমি এর মধ্যেই তোমার কাছে স্মৃতি হয়ে গেছি!
- স্মৃতিতো স্মৃতিই। আজ সকালে পানি খেতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে যে গ্লাসটি ভেঙ্গে গেছে সেটিও এখন আমার কাছে স্মৃতি।
- তাহলে কোথায় আসবো?
- নতুন কোনো জায়গায়। নতুনভাবে দেখি-নতুন তোমাকে...
আজ তিনমাস পরে অভীক আর নীলার দেখা। যদিও সময়ের হিসাবে খুবই কম। তবু এরমধ্যেই দুজনেই বদলে গেছে খুব। বিশেষ করে নীলার পরিবর্তনটা বেশ করে চোখে পড়ছে। তার চোখের বিষণ্নতা, চোখের নিচের কালো দাগ এর কিছুই অভীকের চোখ এড়ায় না। তার দুঃখ হয়। তবুও সে নিজেকে সময়ের কাছে নিরুপায় ভাবে।
তাই সবকিছু এড়িয়ে নিছক পোশাকি প্রশ্ন করে- কেমন আছো?
- কেমন দেখছো?
- এমনটি আশা করিনি।
নীলা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। সে অভীকের হাত চেপে ধরে- আমাকে ক্ষমা করো অভীক, আমাকে ক্ষমা করো।
অভীকও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। তার চোখ ছলছল করে উঠে- কী বলছো এসব?
- অভীক তুমি জানো না যে তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে আমার জীবনটা কতোটা অভিশপ্ত হয়ে গেছে।
- কী বলছো তুমি এসব?
- সত্যি বলছি! তুমি জানো না আমার ওপর দিয়ে এখন কী পরিমাণ ঝড়-ঝাপটা বয়ে যাচ্ছে। গতমাসে বাবা স্ট্রোক করেছেন, তাকে নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে করতে শেষ। এর ভেতরে গত সপ্তায় আবার হাইজ্যাকারের কবলে পড়েছি। আমার মোবাইল, বেতনের টাকাসহ সবকিছু মিলিয়ে প্রায় পঁচিশ/তিরিশ হাজার টাকার মতো নিয়ে গেছে। তার ভেতরে গতকাল আবার অ্যাকসিডেন্ট করেছি। এতক্ষনে হয়তো আমি মরহুমা হয়ে যেতাম। অল্পের জন্য- বলতে পারো আল্লাহ নেমে আমাকে বাঁচিয়েছেন। তারপর থেকেই আমার মনে হচ্ছে আমর ওপর কারো অভিশাপ রয়েছে। বিশ্বাস করো কাল সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। শুধু মনে হচ্ছিল আমার ওপর কারো অভিশাপ রয়েছে।
- এসব তুমি কী বলছো!
- সত্যি বলছি! তুমি জানো না ইদানিং আমার জীবনটা একদম হেল হয়ে গেছে। অফিসে ডিজিএম- এর সাথে গন্ডোগোল চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। এদিকে এমবিএর রেজাল্ট নিয়েও আমি বেশ ডাউটফুল। সারাক্ষন শুধু দেখি একটা কালো ছায়া আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মনে হয় সেটা তোমারই ছায়া।
- নীলা, তুমি এসব আবোল তাবোল কী বলছো!
- আবোল তাবোল না। ঠিকই বলছি। আমার জীবনে যখন আমি কাউকে কষ্ট দিয়েছি- কেউ আমাকে অভিশাপ দিয়েছে তখনই তার ফল আমি পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি জানতাম না যে আমি তোমাকে ছেড়ে গেলে তুমি কষ্ট পাবে। যদি জানতাম তবে এমনটি করতাম না।
- নীলা আমিও তাই জানতাম। জানতাম, তুমি বুঝতে পারোনি যে আমাকে ছেড়ে গেলে আমি কষ্ট পাবো। কিন্তু আমি এটা জানতাম না যে তুমি এত নীচ-আমাকে এতটা ছোট মনের ভাবতে পারো। আরে আমাকে ছেড়ে তুমি সুখি হতে চেয়েছো বলেই তো আমি তোমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করেছি এবং করছি। আর আজ তুমি আমার কে যে তোমার সুখ-দুঃখ নিয়ে আমি মাথা ঘামাবো? কেনই বা আমি তোমাকে অভিশাপ দেবো?
- তুমি যা বলছো তা মানছি। কিন্তু আমার কেবলই মনে হয় আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি বলে তুমি আমাকে অভিশাপ দিচ্ছ।
- আসলে আসলে তোমার এমনটি মনে হচ্ছে কারণ তুমি অপরাধবোধে ভুগছো। আমাকে অকারণে কষ্ট দেয়ার কারণে তুমি নিজেকে অপরাধী ভাবছো। আর তাই তোমার এমনটি মনে হচ্ছে।
- অভীক সে তুমি যা-ই বলো আমি সুখি হতে চাই, আমি আগের মতো নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাই। আমাকে ক্ষমা করো অভীক, আমার ওপর থেকে তোমার অভিশাপ তুলে নাও।
অভীক কিছু বলতে পারে না। সে মুখ ঘুরিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। তার চোখ ছলছল করে উঠে। সেদিন- যেদিন নীলা চলে গিয়েছিলো- সেদিন অভীক যতটা দুঃখ পেয়েছিল, আজ এই মুহূর্তে নীলার প্রতিটি কথা তাকে তার চেয়েও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। নীলার প্রতিটি কথা তার বুকে পেরেক ঠুকছে। তার চোখ থেকে টপাটপ গড়িয়ে পড়ে কয়েকফোঁটা অশ্র“। নীলার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু কোনো উত্তর আসে না অপর পাশ থেকে। সে পা বাড়ায় পথে- তার একুশ শতকের মন নিয়ে। নিমেষে সব ভুলে যায়। সিএনজি ডাকে চিকন সুরে। পা বাড়াতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ায়। পরিচিত কাউকে দেখে হাত নাড়ে- হাই।
Comments: