নুজহাতের অপমানাহত মুখ দেখে প্রত্যয় খুশি হয়। বিজয়ের আনন্দে নেচে উঠে তার মন। মনে মনে ভাবে মেয়েদের হারানো এত সহজ! চাইলেই যে কোনো মেয়েকে শুধু চোখের ভাষার অবজ্ঞায়ই এমনভাবে অপমান করা যায়! অথচ-অথচ সে কি না আগেই পরাজিত হয়ে বসে আছে। তাও আর কারো কাছে নয়- এক সাধারণ কিশোরীর কাছে। ভাবতেই তার বিজয়ের আনন্দ আর দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মুহূর্তেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। নুজহাতের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে হঠাৎ উদাস হয়ে যায়।
আসলে সে কখনই এ রকম ছিল না। আর দশটা ছেলের মতোই সুন্দর স্বাভাবিক জীবন যাপন ছিল তার। সেও সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতো। অন্যের কাছে নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করতো। সবসময়ই চাইতো সবাই তাকে আকর্ষনীয় ভাবুক। ছেলেরা তাকে দেখে হিংসায় পুড়ুক। আর মেয়েরা- এক কথায় ফিদা হয়ে যাক। ইদানিং হচ্ছেও তাই। কিন্তু সে এটা উপভোগ করতে পারছে না। তার ভেতরে ভর করেছে অদ্ভুত এক খেয়ালীপনা। অদ্ভুত পাগলামী। মুহূর্তেই কেমন যেন হয়ে যায় সে। কেমন প্রতিহিংসাপরায়ন। মনে হয় প্রতিপক্ষের আহত চোখের করুণ চাহনিই যেন তার একমাত্র কাম্য।
এটা তার বন্ধুরা প্রায়ই লক্ষ করে। তাকে প্রায়ই এ বিষয়ে বলে। কিন্তু সে তার আপন খেলায় মত্ত। সে হঠাৎ ভাবে আজ যদি জয়িতা তার সামনে এসে দাঁড়ায়- তার সাথেও সে কি এমন করবে? হঠাৎ জয়িতার নাম মনে আসতেই সে আরও উদাস হয়ে যায়। আসলে সেই জীবনে জয়িতাই তো ছিল তার সবকিছু। সবাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করতো, ভালো রেজাল্ট করতো। আর সে শুধু জয়িতাকে পাওয়ার জন্যই এসব করতো। তবু কী যেন একটা ব্যাপার- একটা সংশয় তাকে জয়িতার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। একসময় সত্যি সত্যিই জয়িতা তার কাছে থেকে দূরে সরে যায়। তখনই সে উপলব্দি করে জয়িতা তাকে হারিয়ে দিয়েছে। যেন দূরে থেকে মুচকি হেসে বলছে- কীসের এত জিদ তোমার- এত অহংকার! তোমার অহংকারে আমার কিছুই যায় আসে না। সে মুষড়ে পড়ে। অসহায়ের মতো মাথা চাপড়ায়। তবু কিছুই হয় না। শুধু মনে হয় এ যেন এক কিশোরীর কাছে তার করুণ পরাজয়। এর প্রতিশোধ নেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তারপর থেকে সে যেন অন্য এক প্রত্যয়ে দীপ্ত প্রত্যয় হয়ে উঠে। নিজেকে স্থাপন করে নতুন এক ফ্রেমে। সবকিছুই এসে তার পায়ে লুটায়। ভালোবাসা, সম্মান আরও যা যা চায়। একসময় সে আবিস্কার করে যে এক কিশোরীর জন্য সে বিশ্ব জয়ের দৃঢ় প্রত্যয়ে নেমেছিল অথচ এর কোনো কিছুরই দরকার নেই। হাত বাড়ালেই সব মেলে। তখন সে যেন এক নির্লিপ্ত সাধুর মতো নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে আনন্দ খুঁজে পায় যখন তার এই নির্লিপ্ত সন্ন্যাস জীবন কাউকে কাউকে ভীষণভাবে আহত করে। মাঝে মাঝে ভাবে যার জন্য তার এইসব পাগলামি সে কি তার কথা ভাবে! সে কি আদৌ কখনও তার কথা ভাবতো! সে কি কখনও জানতো যে তার জন্য এক কিশোর মুসা ইব্রাহীম হয়ে হিমালয়ের চূড়া থেকে নীলপদ্ম আনতে পারতো; বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দিতে পারতো নিশ্চিন্তে। সে কি জানতো এক কিশোরের চোখে বিশ্ব জয়ের নেশা ছিল শুধু তার জন্য। শুধু তার বাহবা কুড়ানোর জন্য।
আবার যেন প্রত্যয়ের মনে খটকা লাগে। ভাবে আসলেই সে কি জয়িতাকে ভালোবাসতো? যদি সত্যিই তাকে ভালোবাসতো তবে প্রকাশ করেনি কেন? না কি সে শুধু জয়িতার দৃষ্টি আকর্ষন করতে চেয়েছে। কিংবা তার কাছে থেকে বাহাবাটুকুই পেতে চেয়েছে। যেমন এখন অনেকের কাছে থেকেই পাচ্ছে। হৃদিকা, রুহিতা,নাজিফা আরো অনেক নাম। কিন্তু এসব কিছুই এখন তার কাছে কিছু মনে হয় না। আচ্ছা, জয়িতা কি এখন তার কথা ভাবে? কখনও ঘরের কাজের ফাঁকে মন বিষণ্ন হয়ে গেলে। কিংবা কোনো সুন্দর মুহূর্তে তার কি মনে হয়-ইস্ এখন প্রত্যয়টা পাশে থাকলে খুব মজা হতো। মনে হয় সেরকম কিছুই হয় না। প্রত্যয়েরও যে সেরকম কিছু হয় তা না। শুধু মাঝে মাঝে তার খেয়ালী আচরণের পরে মনে হয় এ ব্যাপারটা বোধ হয় জয়িতার কারণেই হচ্ছে। তখন সে ভাবে এসব করে লাভ কী? এতে তো জয়িতার কোনো লাভ- ক্ষতি হচ্ছে না। কিংবা সে তো এর কানাকড়িও জানছে না। তখন সে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে ভাবতে চেষ্টা করে।
কিন্তু পারে না। সে একই বৃত্তে আটকে পড়ে। মনে হয় এটা যেন তার সাইকোলোজিক্যাল প্রোবলেম। কোনো সাইক্রিস্ট- এর কাছে গেলে সে হয়তো বিশাল লম্বা এক মানসিক রোগের নাম বলবে। দেবে ডিপ্রেশন দূর করার ওষুধের নামে একগাঁদা ঘুমের ওষুধ কিংবা আরো কিছু। কিংবা ড. মেহতাব খানমের কাছে এ বিষয়ে লিখলে তিনি হয়তো পরামর্শ দিয়ে দু'তিন পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলবেন।
কিন্তু প্রত্যয় ভাবে সে এক অদ্ভুত চক্রে পড়ে গেছে। তাকে এই চক্র নিয়েই বাঁচতে হবে। তার মনে পড়ে প্রিয় কবি হেলাল হাফিজের নতুন কবিতার কথা-
“তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো।”
সে যেন এই ভয়েই কাউকে তার নিঃসঙ্গতার রাজ্যে প্রবেশ করতে দেয় না। অদ্ভুত অহংকারে সে যেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে তার নিঃসঙ্গতার স্বর্গরাজ্য।
Comments: