ড্রিম সিকোয়েন্স-আনসেন্সরড্

ড্রিম সিকোয়েন্স-আনসেন্সরড্

সোহেল মাহরুফ





হাঁটার অভ্যাসটা আমার ছেলেবেলা থেকেই ছিল। ছেলেবেলাটা গ্রামে কেটেছো তো- তাই শেখার ভেতরে হাঁটা, সাঁতার কাটা, গাছে চড়া আর ছিঁচকে চুরিটাই শিখেছি। এর মধ্যে হাঁটাটা যে উত্তম কাজ তা স্বীকার করতেই হবে-বিশেষ করে যখন বনানী- ধানমন্ডির এ্যাপার্টমেন্টের লোকেরা সকালের বিছানার আরাম ছেড়ে মর্নিং ওয়াকে বের হন, ডায়েবেটিস- হার্ট অ্যাটাকের ভয়ে। অবশ্য হাঁটার অভ্যাস থাকার কারণে আমারও একটি লাভ হচ্ছে। তা হলো- সিগারেটের জন্য বাবা মায়ের কাছে থেকে মিথ্যা বলে টাকা নিতে হয় না। বাস ভাড়া, রিকশা ভাড়া বাঁচিয়ে তা দিয়েই সিগারেটের খরচ মেটাই।


ইদানিং হাঁটার অভ্যাসটা আরও বেড়ে গেছে। দেড় বছর হলো ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছি। এখনও কোনো চাকুরি পাইনি। বাবা আমার উপর বেশ চটে আছেন। সে জন্য সচারাচর তার সামনে পড়ি না। দিনে হয়তো দু’একবার তার মুখোমুখি হই। আর তখন তিনি তিলে তিলে বুঝিয়ে দেন যে তিনি চাকুির জীবনে সেরকম একজন ছিলেন। এর বেশি আর কিই বা করবেন? সততার ফলাফলস্বরূপ তার অবসরের পর বসের মেজাজ ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই। এখন সামনে দেখলেই গর্জন করে উঠেন- ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি ফাইলে লইয়া রাস্তায় রাস্তায় হাঁটার জন্যেই কি পড়াশুনা করিয়েছি। গাধা কোথাকার! এতবছর ধরে কী পড়াশুনা করেছিস্? আমরা তো পাশ করার সাথে সাথেই চাকুরিতে ঢুকেছি।


বাবার কথা শুধু শুনেই যাই। তাকে বোঝাতে পারি না যে সে সময় আর এ সময়ের মধ্যে কত পার্থক্য। তার এক কথা- যোগ্যতাই সব। যোগ্যতা থাকলে কেউ ঠকাতে পারে না।


এসব ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে বাঁচার জন্যই সারাদিন বাইরে বাইরে কাটাই। হয়তো বা পার্কে বসে থাকি। মাঝে মাঝে পার্কে বসে বইও পড়ি। একেকটি বই চার-পাঁচবার করে পড়ে ফেলি। তারপরও যখন দেখি সময় কাটে না তখন আমার শৈশবের শিক্ষা চর্চা করি। শুরু করি আমার বিখ্যাত হাঁটা। শহরের এ গলি থেকে ও গলি। এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত শহরের পথ থেকে পথে হেঁটে হেঁটে সময় কাটাই। তারপর চুপি চুপি বাসায় ফিরে দেখি মা তখনও আমার জন্য টেবিলে ভাত সাজিয়ে বসে আছেন।


এ পর্যন্ত তেষট্টিটি ইন্টারভিউ দিয়েছি। কেরানি থেকে শুরু করে ম্যানেজার পর্যন্ত সব পদের জন্যই। এখন শুধু বাকি আছে সিকিউরিটি গার্ড মানে দারোয়ান পদের জন্য ইন্টারভিউ দেওয়াটা। আর কয়েকমাস পরে হয়তো সেটাও পূরণ হবে।

 

সেদিন সকালেও একটি ইন্টারভিউ ছিল। সে যাত্রায়ও যে চাকুরির ফাঁদে পা পড়বে না তা আমি জানতাম। কেননা, আবেদন করেছি মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ পদের জন্য। অথচ সে সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস না করে গরু সম্বন্ধে ইংরেজিতে দশটি বাক্য বলতো বললো। এর চেয়ে চূড়ান্ত রসিকতা আর কি হতে পারে! অবশ্য আমিও ছাড়বার পাত্র নই। বলে দিয়েছি- আজকাল গরুরা মাঠে চড়ে না, শহরের অফিসগুলোর গদিওয়ালা চেয়ারে বসে বসে ঝিমোয়। তারপর আর কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। চলে এলাম। তারপর আবার সেই বিখ্যাত হাঁটা। দুপুরের লাঞ্চ বলতে একটি সিগারেট আর দু’গ্লাস পানি। এই অবস্থাতে সারাটি বিকালও কাটিয়ে দিলাম।


ধীরে ধীরে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়লো। অবশ্য এটির প্রতি আমার কোনোকালেই কোনো আকর্ষন ছিল না। আর এখনতো নেই-ই। এই গোঁধুলির আলো আঁধারিতে কোনো কবিতার ভাব আমার ভেতরে আসে না। আমি চাই না এই গোঁধুলি আরেকটু ঝিরোক। আমি চাই এক নিমেষে সূর্য ডুবে যাক- চাঁদ জেগে উঠুক; ঘোষনা করুক- এখন গভীর রাত। ডিজিট্যাল ঘড়ির সংকেত শীঘ্রই বলুক বারোটা পার হলো, পথিক এবার ঘরে চলো।


দেখতে দেখতে সন্ধ্যা উতড়ে গেলো। আমি একটি গলির ভেতর দিয়ে হাঁটছি। গলিটা বেশ লম্বা। তবু বড় রাস্তার ফুটপাতের ঝঞ্জাল এড়ানোর জন্যই এ পথ দিয়ে যাচ্ছি। গলিটা কেমন ফাঁকা এবং অন্ধকার। আসলে রাস্তার পাশে লাইটপোস্ট আছে কিন্তু লাইট নেই। চাঁদের আলোতেই যা একটু পথ দেখা যায়। হয়তো এ বিষয়ে কমপ্লেইন করলে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা রসিকতার সুরে বলবেন- নগরবাসীকে প্রকৃতির কাছাকাছি নেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা।


কিন্তু এ পথ দিয়ে কতটা অপ্রকৃতস্থ হয়েই যে চলতে হয় তা তারা সন্ধ্যার পর একবার হাঁটলেই বুঝবেন। অন্ধকারে যেমন উন্মুক্ত ম্যানহোলে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি রয়েছে হাইজ্যাকারের অতিথি হবার সৌভাগ্য। সেজন্যই সন্ধ্যার পর এ পথে লোকজন কম চলাচল করে। আমার অবশ্য হাইজ্যাকারের ভয় ছিল না। কেননা, তখন পকেটে দুটো সিগারেটের পয়সাই মাত্র ছিল। তা নিলে তো আর তেমন গায়ে বাঁধবে না। তবে যদি প্যান্ট শার্ট খুলে নিয়ে যায় তো অন্য কথা। বিশেষ করে সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, একজনের কাছে টাকাপয়সা না পেয়ে হাইজ্যাকাররা তার পায়ের নতুন জুতা খুলে নিয়ে গেছে। আমি কিন্তু সাবধানেই চলছিলাম। কারণ হাইজ্যাকারের হাত থেকে বাঁচা গেলেও অন্ধকারে ম্যানহোল ছেড়ে দেবে না। মুখের কাছে পেলেই গলাধঃকরণ করবে। ভালো না খারাপ তাও ভাববে না। 


সন্ধ্যার এই অন্ধকারে আমি একাকী পথ চলছি-অতি সন্তর্পনে। হঠাৎ পেছনে শুনি মেয়েদের জুতার হিলের ঠুক ঠুক শব্দ। তারও পেছনে কিছু ছেলেদের কণ্ঠ। হেড়ে গলার গান ভেসে আসছে-

“আইজ পাশা খেলবো রে সাম

ও সামরে তোমার সনে-

একেলা পাইয়াছি রে সাম...”


আমার কাছে লক্ষনটা তেমন একটা ভালো ঠেকছে না। আমি চলার গতি বাড়িয়ে দিলাম। কেননা, এসব কেলেঙ্কারীর আশেপাশে থাকলেও বেকুব বনে যেতে হয়। নাম উঠে যায় খদ্দেরের খাতায়। কিন্তু পেছনের শব্দ শুনে মনে হলো- আমি যত দ্রুত পা চালাচ্ছি পেছনের পা দুটো যেন তার চেয়েও দ্রুত চলছে। কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো করেই হাত জড়িয়ে ধরে কে যেন একজন মেয়েলি কণ্ঠে বললো- ‘এই তুমি এত তাড়াতাড়ি হাঁটছ কেন- আমি দৌঁড়েও পারছি না।’


কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন কতদিনের চেনা। আমি বিস্মিত-সন্দিহান চোখে তাকাতেই দেখি- ও মূর্তি ইহজন্মে দেখিনি। তবু কোনো এক অজানা কারণে আমি আশ্বস্ত হলাম। ঘাড় ঘুরাতেই পেছনের দিকে ইঙ্গিত করলো। আমি আমার মতো করেই অনুমান করে নিলাম ব্যাপারটা।

 

দু’জনে এভাবেই চললাম অনেকক্ষন- যতক্ষন না বুঝলাম ওরা পিছু ছেড়েছে। আমার কাছে ভালোই লাগলো। বিশেষ করে যখন মনে পড়লো কিশোর বয়সে দেখা ফিল্মের দৃশ্যের কথা। তখন ফিল্মের নায়ক- নায়িকাদের ফ্রি স্টাইলে চলাফেরা দেখে ভাবতাম আমার জীবনটাও যদি অমন হতো। যদি পারতাম অমনভাবে দুপুরে বা সন্ধ্যায়, বৃষ্টিতে বা কড়কড়ে রোদ্দুরে কারো হাত ধরে গলিতে কিংবা রাজপথে, পাহাড়ে কিংবা সাগরপাড়ে নাচানাচি কিংবা ধাপাধাপি করতে কিংবা জড়াজড়ি করে হেঁটে যেতে। সেজন্য ভালোও বেসেছিলাম একজনকে। কিন্তু তাকে অত আপন করে পাওয়া হলো না। তার আগেই বিচ্ছিন্ন হতে হলো দু’জনকে। আসলে আমাদের জন্য এসব প্রেম- ভালোবাসা নয়। ওসব ধনীর দুলালদের জন্য। তারা যদি চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ইংলিশ ছবির স্টাইলে ঠোঁটে ঠোঁটও চেপে ধরে তাতে কেউ কিছু বলবে না। বরং সবার কাছে দৃশ্যটা বেশ উপভোগ্যই হবে। কিন্তু আমাদেরকে গলির মোড়ে দু’দিন কথা বলতে দেখলেই ছোট গলির দেয়ালে দেয়ালে কানাঘুষো শুরু হয়ে যায়। আর এইসব তুচ্ছ কারণেই আমাদের বুক ভাঙ্গে যখন-তখন-যত্র-তত্র।


একজন অপরিচিত মেয়ে আমার হাত ধরে আমার পাশে পাশে হাঁটছে। বেশ ভালোই লাগছে। আমার সঙ্গিনীই প্রথম নিরবতা ভাঙ্গলেন- সেই সাথে আমার হৃদয়ও।


-সরি। বলেই হাতটা সরিয়ে নিলেন প্রথমে। যদিও মুখে বললাম “অলরাইট, অলরাইট” কিন্তু মনে মনে বললাম- ‘সুন্দরী সরি হয়েছো বেশ ভালো কথা কিন্তু হাত ছেড়ে দিয়ে আমাকে সরি করে কী লাভ তোমার!’


তারপর তিনি ঘটনার একটি নাতিদীর্ঘ ডেসক্রিপশন দিতে শুরু করলেন- আসলে আমার এক বান্ধবী এদিকটায় থাকে। তার সাথে দেখা করতেই এসেছি। গলিটার অবস্থা যা জঘন্য তাই গাড়ি মেইনরোডে রেখে এসেছি।


গাড়ির কথা শুনে আমি মনে মনে বেশ পুলকিত হলাম। ভাবলাম বেশ ভালো জিনিসই পেয়েছি।


তিনি তার কথা চালিয়েই যাচ্ছেন- বের হতে একটু দেরি হয়ে গেলো। তারপরতো সব আপনিই দেখলেন। আপনি না থাকলে আজ কী যে হতো!

আমি তখন একটু মুরুব্বি সাজার চেষ্টা করলাম। বললাম- সেটা যখন ভাবছেন তখন সন্ধ্যার পর বাইরে না থাকলেই পারেন। 


এ কথা শোনার পর তিনি এমনভাবে আমার দিকে ফিরলেন যে তার ঘাড় ঘুরানো দেখে মনে হলো তিনি বোধ হয় বলে উঠবেন-“তুমি কোন প্রস্তর যুগের মানুষ হে!” সৌভাগ্য এই যে তিনি সেরকম কিছু বললেন না। এরপর আমি আর কোনো কথা বলার সাহস কিংবা দুঃসাহস দেখালাম না।


তিনিও তেমন কিছু বললেন না। তারপর হঠাৎ কী মনে করে বলে উঠলেন- ফিল্মে অনেক হিরো দেখেছি। কিন্তু বাস্তবেও যে তেমন হিরো থাকতে পারে তা আপনাকে দেখেই মনে হলো।


একথা শুনে আমারতো আকাশ থেকে পাতালে পতন অবস্থা। কিন্তু যেহেতু আমি আকাশে ছিলাম না এবং আশেপাশেই উন্মুক্ত ম্যানহোল ছিল তাই আমার মনে হলো আমি যেন রাস্তা থেকেই পাতালে পড়েছি। কিন্তু তার এমনটি মনে হওয়ার কারণ অনুধাবন করতে পারলাম না। কেননা হিরো হওয়ার মতো তেমন কিছুই আমি করিনি। যা কিছু করার তিনি নিজেই করেছেন। যাকে বলে একেবারে র‌্যাম্বো লেডির মতো করে ঝাঁপিয়ে পড়া। এখন যদি আমার চেহারা দেখে একথা বলেন তাহলে অন্য কথা। কেননা আমার মায়ের দৃষ্টিতে আমার এই রাজপুত্তুরের মতো চেহারার জন্য আমাকে অনেকটা বয়স পর্যন্ত কপালে টিপ দিতে হয়েছে এবং শেষে না পারতে সেই টিপ পায়ের নিচে দিয়ে পথে বের হতে হয়েছে। অর্থাৎ যদি কেউ এই রূপে মুখ লাগাও তবে তার মুখে কালি।


সেদিক থেকে বোধ হয় কথাটি মিথ্যা ছিল না। কিন্তু অন্ধকারে তিনি আমার চেহারা দেখলেন কিভাবে? ভাবতেই মনে হলো তিনি স্রেফ তেলই মারলেন- বিশেষ করে যেহেতু পথ আরও বেশ খানিকটা বাকি ছিল।


আমি যখন মনে মনে এসব ভাবছি তখন তিনি ফাটালেন আরেক লোভনীয় ককটেল। হঠাৎ করেই বলে উঠলেন- আসুন না একদিন আমার বাসায়। 


এ কথা শুনে তো আমি হা। ভাবলাম, শালার ফিল্মই যখন হবে তখন এমন ফিল্মই হওয়া উচিত। আমি সেই ফিল্মের ভেতরেই ঢুকে গেলাম। ভাবতে শুরু করলাম স্টার্টিং থেকে ফিনিশিং পর্যন্ত। তার মানে হলো- তার বাসায় গেলাম। তারপর সে তার বাবা- মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। তারপর তার বাবা আমার বীরত্বের(!) কথা শুনে বেশ খুশি হলেন। খুশি হয়ে বললেন- কী চাও তুমি, হে যুবক? আমি তখন বিণীতভাবে বলবো- বেশি কিছু না একটি চাকুরি আর...। একটু ঢোক গিলে নিলাম। আর ঢোক গিলার সাথে সাথেই গিলে ফেললাম আর এর পরেরটুকু। তারপর পেয়ে গেলাম সেই সোনার হরিণ চাকুরি। তারপর-  তারপর আরও অনেক কিছু। তারপর আবার- আবার সেই নদী-সাগর-পাহাড়... তুমি আমার- আমি তোমার... লা লা লা...


স্বপ্নের ঘোরেই আমি যেন হাঁটছিলাম। তাই কখন বড় রাস্তায় এসে পৌঁছলাম তা আর বুঝতে পারলাম না। তিনি মানে আমার সঙ্গিনী হঠাৎ ‘বাই’ বলেই দামি গাড়ির কালো গ্লাসের আড়ালে হারিয়ে গেলেন। গাড়িটাও নিমেষে উধাও হয়ে গেলো। তারপর আর কী বলবো? কোথায় তার বাড়ির ঠিকানা আর কোথায় তার ফোন নম্বর?


অকারণেই বুক ভেঙ্গে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। ভাবলাম, স্বপ্নের মতোই যদি হলো...

স্বপ্নও কি এমন হয়? হাঃ! 





Comments: