মরীচিকা

মরীচিকা

সোহেল মাহরুফ



যদিও মরুভূমিতে জলের প্রচন্ড অভাব তবু শামছু মিয়ার চোখে জলের অভাব নেই। তার ঘোলাটে চোখ দিয়ে টলটলে স্বচ্ছ অশ্রæ গড়িয়ে পড়ে। মরুভূমির শুষ্ক মাটি তা নিমেষেই শুষে নেয়। শামছু মিয়া একবার তার হাতে রাখা দশ দিনারের নোটটির দিকে তাকায় আর একবার দূরের প্রান্তরের দিকে তাকায়। শূন্যতার পর শূন্যতা। তার সজল শূন্য চোখ সেই নিবিড় শূন্যতার মাঝেই যেন আশ্রয় খুঁজে ফেরে। সে নোটটি দু’হাত দিয়ে মেলে ধরে। দেখে চকচকে একটা নোট। সে শুধু দেখেই আর কিছু ভাবতে পারে না। কি করবে সে এই দশ দিনার দিয়ে। দেশে পাঠাবে কি আর নিজেই বা খাবে কি? ভাবতেই হঠাৎ পকেটে রাখা চিঠির কথা মনে পড়লো। চিঠিটা দেশ থেকে এসেছে- দশ-পনেরদিন আগে। চিঠিটা পাঠিয়েছে মরিয়ম বিবি- ছুনতু-রিনতুর মা। ছুনতু-রিনতু হচ্ছে শামছু মিয়ার দুই মেয়ে। চিঠিটার সাথে তাদের চিঠিও ছিল। কিন্তু সে চিঠি দু’টি ব্যারাকে রেখে এসেছে। শামছু মিয়া চিঠিটা পকেট থেকে বের করে। ঘামে ভিজে একেবারে ল্যাতলেতে হয়ে গেছে। সে অতি সন্তর্পণে চিঠির ভাঁজ খোলে। একবার চোখ বুলিয়ে যায় চিঠির শুরু থেকে শেষে পর্যন্ত। শুরুতে প্রেম- ভালোবাসার অনেক কথা আছে। কথাগুলো শামছু মিয়ার খুব ভালো লাগে। পড়লে শরীরের মধ্যে কেমন যেন একটা ভাব চলে আসে। কিন্তু এ মুহূর্তে শামছু মিয়ার কাছে এ কথাগুলোও ভালো লাগছে না। সে দ্রুত চোখ বুলায় চিঠির মাঝের অংশে। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে মাঝের অংশটুকু-

“পরসংবাদ, আফনে বাড়ি থেকে গেলেন আইজ চাইর মাস গত হইলো। এরমধ্যি খালি দুইখান চিডি দিলেন। টাহা পয়সার কি ব্যবস্থা করলেন তাও বললেন না। এদিকে আফনের রাইখ্যা যাওয়া টাহাও ফুরাইয়া গ্যাছে। দুই মাসের বাড়ি ভাড়া দুই হাজার টাহা বাকি পড়ছে। বাড়িওয়ালা খালি তাগাদা দিতেছে। ছুনতু রিনতুর মাস্টারের দুই মাসের বেতন বারো শ’ টাহা বাকি। এদিকে হারুনের দোকানেও ম্যালা বাকি জমছে। ও সওদাপাতি দিতে চায় না। কাশেম চাচা এরমধ্যি দুই তিনবার আইছে। কিস্তির টাহার লইগ্যা তাগাদা দিয়া গ্যাছে।...”

শামছু মিয়া আর ভাবতে পারে না। চোখে শুধু অন্ধকার দেখে। আবার তাকায় মরুভূমির ধূ ধূ প্রান্তরের দিকে। ভাবে কোত্থেকে কি হলো।


বাপ মায়ের এক পোলা আছিল শামছু মিয়া। বাপ মরার সময় যে সম্পত্তি রেখে গেছে তাতে তার ভালোই চলতো। তার ছিল তিন বিঘা ধানি জমি, ষোল শতাংশ জায়গার ওপর বাড়ি, তিনটা গাই আর দুইটা হালের বলদ। গায়ে গতরে খেটে তার নিজের তিন বিঘার সাথে আরো কিছু বর্গা জমিতে যে ফসল হতো তাতে তার চার জনের সংসারের বছরের খোরাক হয়ে বাড়তিও থাকতো। তার ওপরে তার বাড়ির পেছনের পুকুরে মাছ চাষ করে সেখান থেকেও সে নগদ আয়ের ব্যবস্থা করেছিল। আর বাড়ির ভেতরের খালি জায়গায় সবজি বাগান করেছিলো তার বউ মরিয়ম বিবি। সব মিলিয়ে ভালোই ছিল। গ্রামে তাকে গৃহস্থী হিসেবেই সবাই সম্মান করতো। তারপর কি থেকে কি হয়ে গেলো...


পাশের বাড়ির মল্লিকেরা- তিন/চার বছর আগেও অভাব ছিল তাদের নিত্য সঙ্গী। গ্রামের এমন কেউ ছিল না যাদের কাছে তাদের ধার দেনা ছিল না। এমনকি ফি বছর শ্রাবণ ভাদ্র মাসে যখন চারদিকে আকাল তখন মল্লি­কের বউ এসে মরিয়ম বিবির কাছ থেকে চাল ধার নিতো। সেই মলি­কের অবস্থা হঠাৎই বদলে গেলো যেই না তার ছোট শালা তার বড় ছেলে আরিফকে এখানে নিয়ে এলো। এরপর দেখতে না দেখতেই মল্লি­কের জমি হলো- বিঘার পরে বিঘা, গোলের ছাউনির ঘর চোখের পরেই পাকা বাড়ি হলো। আর এর সাথে সাথে তার দাপটও বাড়তে লাগলো। এরপর থেকে সবাই তাকে গ্রামের শালিশ বিচারে ডাকতে শুরু করলো। বাজারে গেলে মাছওয়ালারা বড় মাছটা তার ব্যাগে তুলে দিতো। এগুলো সব শামছু মিয়া তার চোখের পরেই দেখেছে। এরপর একদিন শোনে মল্লিক হজে যাবে। দেখতে দেখতে তাও হয়ে গেলো। বদলা বেচা মল্লিক রাতারাতিই হয়ে গেলেন আলহাজ্ব কাশেম মল্লি­ক। তারপর তার খায়েশ হলো ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার। এবং সে সেভাবেই এগোতে শুরু করলো। এসব দেখে শামছু মিয়ার মনে হলো কুয়েতে আসলে তেলের খনি নয় টাকার খনি আছে। সে তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো তাকেও কুয়েতে যেতে হবে- যে করেই হোক। তাতে একসঙ্গে দুই লাভ- টাকা আয় করাও হবে এবং একবারে সৌদি আরব হয়ে হজও করে আসবে। এরপর থেকে সে মনে প্রাণে সেভাবে প্রস্তুত হতে লাগলো। সেবার মল্লিকের ছেলে যখন দেশে আসলো তখন শামছু মিয়া কাশেম মলি­কের কাছে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বললো- চাচা, আরিফতো কত লোকেরেই বিদেশ নেয়। আমারও একটা ব্যবস্থা কইরা দিতে কন। মনে বড় খায়েশ হইছে নিজ চক্ষে একবার গিয়ে আরবভূমি দেইখা আসি।

এ কথা শুনে মল্লিক হেসে বললো- খায়েশ হইছে তয় যাইবা। হেইডার লইগা এমন বাইলে কওনের কি আছে? আমি আরিফরে কইয়া দিমুনে। তা তুমি টাহা পয়সা জোগাড় করো। 

এরপরে সে তার আরব দেশের কাহিনি বর্ণনা শুরু করে- মিয়া একবার যদি যাইতে পারো তাইলে বুঝবা আরব দেশ কি জায়গা। খাওনে লওনে এক্কালে খানদানি কারবার। মিয়া হেই দেশে কেউ পানি খায় না। ফ্রুট খায় ফ্রুট-ফল- আঙুর, কমলা, আরো কত কি? দেখবা দুই মাস থাকলে চেহারা কেমন টসটসা হইয়া যায়।

তখন শামছু মিয়াও সায় দেয়- হয় চাচা হেইডা আর কওন লাগবে না। হেইডা তো আপনেরে দেইখা বুঝতে পারছি। 

তখন মল্লি­ক তাকে বলে- বুঝছো যহন তহন বইসা আছো কেন? যাইয়া টাহার ব্যবস্থা করো আর আমি আরিফরে কইয়া তোমার সক্কল ব্যবস্থা করতাছি। আরে মিয়া বিদ্যাশ যাওন কইতে যত সোজা যাওনতো তত সোজা না। আইজ হইতে কামে নাইম্যা পড়ো। 

সেই থেকে শুরু। আজ পাসপোর্ট করতে দাও, কাল ভিসার পয়সা দাও, তো অমুক দিন মেডিকেল করাও এভাবে করতে করতে দেখা গেলো শামছু মিয়ার সবকিছু উধাও। দেখতে দেখতে তার হালের গরু নাই হয়ে গেলো। নাই হয়ে গেলো তার তিন বিঘা ধানি জমি। বাকি রইলো শুধু বসতভিটা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দেখা গেলো বিমানের টিকেটের পয়সা তার কাছে নেই। এমনকি ঘরে দু’য়েকমাসের খোরাকী রেখে যাওয়ার মতো পয়সাও তার নেই। তখন বাড়িটা মল্লি­ক সাহেবের কাছে বন্ধক রেখে সে টাকা ধার নেয়। বিমানের টিকেট বাবদ যা লাগে তা রেখে বাকিটা মরিয়ম বিবির হাতে তুলে দেয়। তাদেরকে একটা ভাড়া ঘরে রেখে শামছু মিয়া পাড়ি জমালো মরুর দেশে-  তার স্বপ্ন সাধনের উদ্দেশ্যে। যদিও পুরো ব্যাপারটাতেই মরিয়ম বিবির অমত ছিল তবু শামছু মিয়া তাকে বুঝিয়েছে যে সেখানে গিয়ে পড়তে পারলে এর চেয়ে দশগুণ বেশি সম্পদ তাদের হবে।


সে দেশ থেকে এসেছে আজ চারমাস হয়েছে। এর ভেতরে দেশে যা পাঠিয়েছে তা হলো দুই খানা চিঠি- আর কিছুই না। আর কিই বা সে করবে। যে স্বপ্ন নিয়ে সে এদেশে এসেছিল তা তো তার প্রথমদিনেই ভেঙ্গে গেছে।


এসে যখন দেখলো তার কাজ হলো মরুভূমিতে দুম্বা চড়ানো আর তার আবাস হলো জেলখানার মতো দেখতে একটা ব্যারাকে তখনই সে বুঝলো তার ভুলই হয়েছে। কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তাই সে নিরুপায় হয়ে নিজেকে ভাগ্যের ওপরেই ছেড়ে দিলো। আর মাসের শেষে যা দেখলো তা হলো তার বেতন হচ্ছে পঞ্চাশ দিনার। যা দিয়ে এখানে একজন মানুষের খেয়ে পড়ে থাকাই কষ্টকর- দেশে পাঠানোর কথা দূরে থাক। শামছু মিয়া তবুও ভাবে তার ভাগ্য ভালো যে তাকে কোম্পানি থেকে ব্যারাকে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। না হলে হয়তো তাকে এখন এই শীতের ভেতরে মরুভূমির খোলা প্রান্তরেই রাত কাটাতে হতো। এভাবেই তৃপ্তিতে আর আফসোসে শামছু মিয়ার দিন কাটতে থাকে। প্রতিমাসেই ভাবে এ মাসে টাকাটা দেশে পাঠাবে। কিন্তু বেতন হাতে পাওয়ার পর সে আর হিসাব মিলাতে পারে না। কি ই বা দেশে পাঠাবে আর নিজের চলার জন্যই বা কি রাখবে। ভাবতে গেলে প্রায়ই তার মাথা গুলিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত দেশে আর টাকা পাঠানো হয়ে ওঠে না। এভাবে দেখতে দেখতেই কেটে গেলো চার মাস। শামছু মিয়া এখানে পড়ে আছে তার সামনে ধূ ধূ মরুভূমি নিয়ে আর দেশে তার স্ত্রী- সন্তানেরা পড়ে আছে সমুখে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে।


হঠাৎ দূরে প্রান্তরের দিকে শামছু মিয়া কী যেন দেখতে পায়। তার ভাবনা চিন্তা ভুলে সে হঠাৎ হনহন করে সেদিকেই হাঁটা শুরু করে।





Comments:

impascamy : Although the number leading CBD oil companies is small, all of them are carefully selected masters, and there is even a tyrannical warrior whose flame has surpassed the eighth order And Amoroso s bodyguards were all veterans who just CBD cannabidiol gummies 500 mg battles cialis online prescription
Lequany : cialis coupons However, pathology tests showed she also had extensive ductal carcinoma in situ, a less invasive form of the disease, which meant Goodacre went on to spend five years taking tamoxifen, an estrogen modulator taken in pill form that helps prevent the development of hormone receptor positive breast cancers
authest : Still, we feel that it does not detract from our plea in favor of the use of combination therapy as first line treatment in most patients with hypertension buy cialis online forum In some embodiments, biologic agents, such as cytokines, may be also used as the therapeutic agent