ভাবনা বিলাস

ভাবনা বিলাস

সোহেল মাহরুফ


মাথার উপরের এসিটা আরেকটু কুল করে দেয়। তবুও হৃদিমাহর অস্বস্তি ভাবটা কাটে না। সে চেয়ারের উপর শরীরটা এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে রাখে। তবু তার অস্বস্তি ভাবটা যায় না। আসলে গল্পটা পড়ার পর থেকেই তার ভেতরে অস্বস্তির ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। গল্পটা সে স্থানীয় একটি পত্রিকায় পড়েছে। আসলে সে সচরাচর স্থানীয় পত্রিকা পড়ে না। দেশি পত্রিকা বলতে শুধু ডেইলি স্টার পড়ে। আর সবসময়ই বাইরের পত্রিকা, ম্যাগাজিন যেমন- ইকনোমিস্ট, টাইম, ফোরচুন  এসব পড়ে। কিন্তু আজ সকালে গাড়িতে বসে পত্রিকাটি পড়লো। মানে সে আর তার বাবা একসাথে বের হয়েছে। পথে যানজটে পরে তার বাবাই পত্রিকাটি কিনেছিলেন। তারপর নামার পথে পত্রিকাটি গাড়িতে ফেলে গেছেন। পত্রিকাটি তার পাশেই পড়ে ছিল। সে আনমনে হাতে তুলে নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে। হঠাৎই মাঝের পাতায় চোখ পড়ে- এটা সাহিত্যের পাতা। সে তাচ্ছিল্যের সাথে পাতা উল্টাতে গিয়েও আবার থেমে যায়। দেখে একটা ছোট গল্প। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে পড়তে শুরু করে। কিছুদূর যেতেই সে আবিষ্কার করে এ যেন তার জীবনেরই গল্প। একান্তই তার ব্যক্তিগত ঘটনা। যা সে, নীতু আর কবীর ছাড়া আর কেউ জানে না। সে গল্পটা দ্রুত শেষ করে ফেলে। আর গল্পটা শেষ হতেই তার অস্বস্তি ভাবটা শুরু হয়। গল্পটা যেন হুবহু তার জীবন থেকে নেয়া। তার জীবনের সাথে পুরো গল্পেরই অদ্ভুত মিল শুধু শেষটা ছাড়া। ভাবতেই তার ভেতরে পুরনো ব্যথাটা চিন চিন করে উঠে। সে গল্পটা আবার পড়ে- আবার পড়ে। এভাবে গাড়িতে বসেই তিন চারবার পড়ে ফেলে। তার মনে হয় গল্পটা আরেকবার পড়লেই বোধ হয় অস্বস্তি ভাবটা কেটে যাবে। কিন্তু প্রত্যেকবারই অস্বস্তি ভাবটা আরো বেড়ে যায়। অফিসে এসেও সে এরিমধ্যে পাঁচবার পড়েছে। গল্পের প্রায় প্রত্যেকটা লাইন তার মুখস্থ হয়ে গেছে। আর প্রত্যেক লাইনের সাথে সে মিলিয়ে নিচ্ছে নিজের জীবনের ঘটনাগুলোকে। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ স্মৃতির পর্দা উঠে যায়।


ভার্সিটিতেই তার সাথে কবীরের পরিচয়। একই সাবজেক্টে- একই ইয়ারে তারা পড়তো। কবীর ছিল প্রত্যন্ত গ্রামের এক দরিদ্র কৃষকের ছেলে। সেসব ফ্যামিলিতে ছেলেমেয়েরা একটু মেধাবী হলে যা হয় আর কি। বাবা মা ভাবে ছেলে বড় হবে- জজ ব্যারিস্টার হবে। তাদের দুঃখের দিন ঘোচাবে। অন্যদিকে আশেপাশের দু’চার গ্রামের মানুষ ভাবে ছেলেটা বড় হয়ে তাদের গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু এদিকে ছেলেটির ঘরে চাউল আছে কি না কিংবা পেটে ভাত আছে কি না সেদিকে খেয়াল নেই। খেয়াল করে ছেলেটা রেজাল্ট কি করল। কবীরের ব্যাপারটা সেরকমই ছিল। মফস্বলের কলেজ থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাস করার পরে সবাই বলল- ছেলে এতো ভালো রেজাল্ট করেছে ওকে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি করো। তার বাবাও ভাবল দশজনে যখন বলছে তখন ছেলেকে মানুষ করার জন্য তাই ই করতে হবে। আসার সময় শুধু বললেন- বাপ তুই কোনো চিন্তা নিস্ না। খরচাপাতি নিয়া ভাবিস্ না। আমি সময়মতো তোর খরচের ট্যাকা পাঠাইয়া দিমু।

কবীর অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তার অমায়িক ব্যবহার আর মেধা দিয়ে ক্যাম্পাসের সবার মন জয় করে নিলো। হৃদিমাহ, নীতু, কবীর এবং আরো কয়েকজনকে নিয়ে তাদের একটি গ্রুপ ছিল। কবীরই ছিল সে গ্রুপের মধ্যমণি। অসম্ভব হিউমার ছিল তার। আর তাই সবাইকে সারাক্ষণ হাসিখুশিতে মাতিয়ে রাখতো। তার এই হাস্যোজ্জ্বল রূপের বাইরে আরেকটি রূপ ছিল। আর তা হলো সে যখন একা থাকতো তখন ভীষণ হতাশায় ভুগতো। এ রূপটা সবাই জানতো না। শুধু তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানতো। তাই যখন রেজাল্ট বের হলে সবাই কংগ্রাচুলেট করতে আসতো সে তখন প্রায়ই বলতো কি হবে এই রেজাল্ট দিয়ে। সেই তো গ্রামে গিয়ে জোয়াল কাঁধে মাঠে যেতে হবে-লাঙ্গল ঠেলতে হবে। এর উত্তরে কেউ আর কোনো কথা খুঁজে পেতো না। তবু হৃদিমাহ মাঝে মাঝে একলা পেলে বলতো- কবীর এভাবে ভাবো কেন? বি পজিটিভ। 

কবীর নিরুত্তাপ চোখ তুলে বলতো- কি রকম?

-না মানে তুমি ভালো ছাত্র। ভালো রেজাল্ট করছো। হয়তো তুমি ভার্সিটিতে টিচার হবে। ভালো একটা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে হাইয়ার স্টাডির জন্য যাবে। 

-তাই? কল্পনায় সবই সম্ভব। কিন্তু বাস্তব কঠিন। হয়তো বাবার অসুখ চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। পড়াশোনা বাদ দিয়ে চাকরিতে ঢুকতে হবে। কিংবা বোনের বিয়ে- টাকা লাগবে। সুতরাং, স্বপ্ন দেখা সহজ।

-কবীর! এভাবে বলো কেন? এমনও তো হতে পারে তুমি ভালো একটা চাকুরি পাবে। তোমার বাবা মা বোনদের ঢাকায় নিয়ে আসবে। বোনদের ভার্সিটিতে ভর্তি করে দেবে।

-তোমাদের জীবনে এমন হওয়া খুবই সম্ভব এবং হয়ও। কিন্তু আমাদের জীবন খুব কঠিন। এখানে যা হওয়ার কথা তাও বেশির ভাগ সময়ে হয় না।


এর উত্তরে হৃদিমাহ কোন কথা খুঁজে পায় না। তবুও সে কবীরকে বোঝাতে চেষ্টা করে- তাকে বদলাতে চেষ্টা করে। আর এভাবে চলতে চলতেই একসময় হৃদিমাহ ফিল করে সে কবীরকে ভালোবেসে ফেলেছে। সে নিসংকোচে তা প্রকাশ করে। কবীর কিছু বলে না। শুধু হাসে। এভাবে সময় বয়ে যায়। হৃদিমাহ কবীরের দিক থেকে কিছু বুঝতে না পেরে অস্থির হয়ে ওঠে। একদিন বলেই ফেলে- কবীর কিছু একটা বলো।

-কি বলবো?

-তোমার কিছু বলার নেই। 

-হৃদি, এ সবই সিনেমা নাটকে সম্ভব- বাস্তবে না।

-কবীর! তুমি আর বদলাবে না। আচ্ছা আমার দিক থেকে তো কোন সমস্যা নেই। তাহলে তোমার সমস্যা কিসের?

-আমারও কোনো সমস্যা নেই।

-তাহলে.....

সময় আর থেমে থাকে না। সময় বয়ে চলে।


একসময় হৃদিমাহর বাবা তার বিয়ে ঠিক করেন। পাত্র এক বিশিষ্ট শিল্পপতির ছেলে। হৃদিমাহ প্রথমে অমত করে। তখন প্রশ্ন উঠে তার পছন্দের কেউ আছে কি না। সে বলতে গিয়েও বলতে পারে না- ভয়ে শঙ্কায়। তার বাবা মা কবীরকে ভালো করেই চিনেন। তাকে খুব স্নেহও করেন। কিন্তু হৃদিমাহ ভালোই বুঝতো যে সেই স্নেহটা মেয়ের জামাই হিসেবে ভেবে করতেন না বরং সেটা ছিল গ্রামের একটা দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছেলের প্রতি তাদের করুণাবোধ। তাই হৃদিমাহ চুপ থাকে। তাকে নিশ্চুপ দেখে তার বাবা মা যা বোঝার বুঝে নেয়। তারা বিয়ের জন্য অগ্রসর হয়। এদিকে হৃদিমাহ কবীরের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে আর ক্যাম্পাসে যায় না। সে সারাক্ষণই ঘরের ভেতর নিজেকে বন্দি করে রাখে। এদিকে তার বিয়ের খবর শুনে কবীর একদিন তাকে ফোন করে। কিন্তু সে লজ্জ্বায় সংকোচে ফোন ধরে না। পরে একদিন কবীর নীতুকে দিয়ে একটি চিঠি পাঠায়।


প্রিয় হৃদি,

           শুভেচ্ছা। তোমার বিয়ের খবর শুনলাম। এ যে হবে তা আমি জানতাম। তাই আমি সব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি। আমার কোনো কষ্ট নেই। প্লিজ, তুমি কোনো পাগলামি করতে যেয়ো না। আমি যেমন ছিলাম, যেমন আছি- তেমনই থাকবো। তোমাকে নিজেকে অপরাধী ভাবার কোন কারণ নেই।

ইতি

তোমারই


চিঠিটা হৃদিমাহর কাছে চপেটাঘাতের মতো মনে হলো। বললো- ঠিক আছে তোমার যখন এত অহংকার তবে তুমি তোমার অহংকার নিয়েই থাকো। সে আর বিয়েতে অমত করে না। অবশেষে নির্দিষ্ট দিনে জাঁকঝমকের সাথে তার বিয়ে হয় বিশিষ্ট শিল্পপতির ছেলে দিহানের সাথে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দিহানের উচ্ছৃঙ্খল জীবন, অত্যাচার নির্যাতনে সে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। না পারতে বছর তিনেকের মাথায় ডিভোর্স, সেপারেশন। তারপর শুরু হলো নূতনভাবে জীবন শুরু করার সংগ্রাম। সে বাইরে পড়াশোনা করতে গেলো। বছর তিনেক কাটিয়ে দেশে আসলো। শুরু করলো এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর এতসব ব্যস্ততায় সে প্রায় সব ভুলেই গেছে। তবু মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না রাতে চাঁদের আলোয় যখন খুব একা লাগতো তখন কবীরের কথা মনে পড়তো। মাঝে একবার উদ্যোগী হয়েছিলো কবীরের সাথে যোগাযোগ করতে। বন্ধু বান্ধব যাদের সাথে যোগাযোগ ছিল তাদের মাধ্যমে খোঁজ নিয়েছিলো। শুনেছে সে একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি এক ঝামেলায় তার যাওয়া হয়নি। তারপর ভার্সিটিতে জয়েন করার জন্য অ্যাপ্লাই করেছে কিন্তু পলিটিক্যাল ব্যাকিং না থাকাতে আর হয়নি। এরপরের আর কোনো খবর কেউ দিতে পারেনি। আর সেও তেমন উৎসাহ পায়নি। তারপর মোটামুটি ভুলেই গিয়েছিলো। কিন্তু আজ আবার মনে পড়লো। গল্পটা পড়ার পরে আবার সেই মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এখন সে ভাবছে যদি গল্পের শেষটার মতো তার সাথে কবীরের আবার দেখা হতো। সে ভাবতে থাকে। ভাবে কিভাবে কবীরের সাথে আবার যোগাযোগ করা যায়। তার মাথায় আইডিয়া আসে। ভাবে, যদি পত্রিকায় কবীরকে উদ্দেশ্য করে একটা বিজ্ঞাপন দেয় তাহলে কেমন হয়। কিন্তু এই বয়সে এসে এসব পাগলামি কি মানায়? ভাবতেই ভাবনারা সেখানে থেমে যায়। পরক্ষণেই ভাবে আচ্ছা কবীরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলে কেমন হয়। কিন্তু এক অজানা আশংকা এসে তাকে ঘিরে ধরে। ভাবে হয়তো সে এতদিনে বিয়ে করেছে- দু’ তিন বাচ্চার বাপ হয়েছে। হয়তো সে সেখানে গেলে দেখবে যে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে কোলে উলঙ্গ নোংরা কোনো শিশু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শরীর বয়সের চেয়ে বেশি নুয়ে গেছে। এই আশঙ্কায় তার ভাবনা আর এগোয় না। সে পত্রিকাটির দিকে আরেকবার চোখ বুলায় তারপর সেটি ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে। জানালার ভারী পর্দা সরিয়ে দেয়। আকাশ দেখতে চেষ্টা করে। কিন্তু দেখতে পারে না। উঁচু ভবনগুলোর আড়ালে আকাশ যেন বন্দি। ঠিক যেন তার মতো। সে যেমন স্ট্যাটাস, প্রেস্টিজ আর অহংকারের আড়ালে অসহায়।




Comments: