রুদ্র নীল ভালোবাসা

রুদ্র নীল ভালোবাসা

সোহেল মাহরুফ


-হ্যালো।

-হ্যালো- রবিন রায়হান বলছেন?

-ইয়েস স্পিকিং।

-আমি জয়া। আপনার একজন ভক্ত।

নামটা শুনে রবিনের বুকে ধাক্কা লাগলো। তবু সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-

-তাই নাকি! শুনে ভালো লাগলো।

-আপনার গতকালের গল্পটা খুব ভালো লেগেছে।

-কোনটার কথা বলছেন?

-ঐ যে ‘রুদ্র নীল ভালোবাসা’।

-ওহ্ আচ্ছা।

-আপনি এত সুন্দর গল্প কিভাবে লিখেন?

-এই আর কি চলে আসে।

-না মানে কনসেপ্টগুলো কিভাবে আসে- বাস্তব নাকি কল্পনা।

-কিছু বাস্তবতা কিছু কল্পনার ছোঁয়া আর কি। আসলে আমাদের জীবনই তো একটা বিরাট গল্প। সুতরাং আমি এই জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশকে নিয়েই কল্পনার রং এ রঙিন করে তুলে ধরি।

-আপনার কথাগুলোও আপনার গল্পের মতোই সুন্দর।

-থ্যাঙ্কস্।

-আপনি কি আমার একটা উপকার করে দেবেন?

-বলুন, চেষ্টা করে দেখতে পারি।

-না মানে, বলছিলাম আমার জীবনের একটা বাস্তব ঘটনা নিয়ে যদি একটা গল্প লিখতেন।

-তাই নাকি! ভেরি ইন্টারেস্টিং!

-লিখবেন তো।

-দেখি আমার ক্ষুদ্র ক্ষমতায় যতটুকু কুলায়।

-সত্যি বলছেন!

-অবশ্যই। তা ঘটনাটা কি?

-অন্য একদিন বলি।

-আজই বলুন না।

-না এটা একটা ইমোশনাল ঘটনা তো। তাই বলার আগে একটু গুছিয়ে নিতে হবে।

-সে কাজটা না হয় এই অধম লেখকের উপরই ছেড়ে দেন।

-তাই! আচ্ছা,- ধরেন একটা মেয়ে---

-ধরেন কেন? এটা কি বাস্তব নয়?

-ধ্যাৎ। আপনি ভারী দুষ্টু।

-তাই নাকি?

-ধ্যাৎ। আপনার সাথে কথাই বলবো না।

-সরি সরি। প্লিজ বলুন। নাউ আই অ্যাম সিরিয়াস।

-নাহ্, এত সিরিয়াস হতে হবে না। এমনি শুনলেই হবে।।

-ওকে।

-আসলে তখন আমি কলেজে পড়তাম। কলেজে ভর্তি হলে সব ছেলেমেয়েদের প্রথম প্রথম যেমনটি হয় আর কি। অর্থাৎ উড়ু– উড়ু– মন... রঙিন স্বপ্ন... এই আর কি। এই ভাবনায় হঠাৎ ছেদ পড়লো যখন হঠাৎ একদিন দেখলাম বন্ধুদের মাঝে একজন একটু অন্য চোখে তাকাচ্ছে। চোখের ভাষায়- আবেগী ইশারায় কিছু বলতে চাচ্ছে। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই লাগতো। তার চাহনিতে আমার ভেতরে কেমন যেন শিহরণ বয়ে যেতো। নিজেকে নিয়ে  তখন খুব গর্ব হতো। একটা পর্যায়ে আমিও তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম। মনে মনে খুব করে চাইতাম যে সে আমাকে মুখ খুলে তার ভালোবাসার কথা জানাবে। কিন্তু সেই দিনটা যেন আসছিলো না। আর যখন এলো...

-তখন?

-তখন হঠাৎ মনে ভয় ঢুকে পড়লো।

-মানে?

-মানে সে যখন একদিন- একদিন আমার হাত ধরে হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিলো তখন হঠাৎ মনে হলো আমি তার ডাকে সাড়া দিলে আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। বিশেষ করে বাবা মা জানতে পারলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না। এছাড়া আমার তখন স্বপ্ন যে আমি ডাক্তারি পড়বো। সেটাও হয়তো আর হবে না। তাই আমি তার চিরকুট ফিরিয়ে দিলাম।

-তারপর?

-তারপর থেকে সে যেন আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠলো। ক্লাস ছুটি হওয়ার পরে সে আমার গাড়ির পেছনে পেছনে আমার বাসা অবধি চলে যেতো। আমার বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো সন্ধ্যা সাতটা আটটা পর্যন্ত। তারপর আবার সকালে কলেজে যাওয়ার আগে দেখতাম সে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দিনে দিনে তার কাছে থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলাম। আর দূরে থেকে তার অধঃপতন দেখছিলাম। দেখছিলাম সে ক্লাসে ধীরে ধীরে অমনোযোগী হয়ে ওঠলো। দেখছিলাম তার দু’গালের গভীরতা দিনকে দিন কেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মাঝে একদিন শুনলাম সে নেশা ধরেছে। তখন আমি সত্যিই তাকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। একদিন লাইব্রেরি থেকে বান্ধবীদের সাথে করে বের হচ্ছি। হঠাৎ সে কোত্থেকে যেন উদয় হলো। হাত ধরেই মিনতির সুরে বললো- জয়া, তুই কি আমাকে বাঁচতে দিতে চাস্ না। তখন বিশ্বাস করবেন না মানে আমার মাথায় যেন রক্ত উঠে গেলো। বিশেষ করে তার এভাবে সবার সামনে আমার হাত ধরাতে আমি ভীষণ অপমানিত বোধ করলাম। আমি তার এই কথার কোন অর্থ না খুঁজে গালে জোরে একটা চড় লাগিয়ে দিলাম।

-তারপর?

-তারপর আর কি? ও পাশের কন্ঠ হঠাৎ যেন আর্দ্র শোনালো।

-সে যেভাবে উদয় হয়েছিলো। সেভাবেই অস্ত গেলো। 

-তারপর?

-তারপর- তার আর কোনো পর নেই। সেদিনের পর থেকে তাকে আর কোনদিন কলেজে দেখিনি। পরে শুনেছি সে কোন মফস্বলে গিয়ে পড়াশুনা করেছে।

-ওহ্ এই তাহলে আপনার গল্প?

-হ্যাঁ এইটুকুই। জানেন সেদিনের পরে থেকে আজও আমি অনুশোচনায় জ্বলছি। জানেন, আমার জীবনে আমি যা যা চেয়েছি তার সবই পেয়েছি। কখনও কখনও তার চেয়ে অনেক বেশি কিছুও পেয়েছি। কিন্তু একটা জায়গাতেই শূন্যতা রয়ে গেছে। আর সেজন্য পুরো জীবনটাকেই শূন্য শূন্য লাগছে। জানেন, আজও আমার দিন কাটে তার অপেক্ষায়। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে মনে মনে প্রার্থনা করি- কাল সকালে আমার দরজার প্রথম মানুষটি যেন সে হয়। কিন্তু কখনও তা হয় না। হয়ত সে হয় ফকির-হকার নয়ত পাশের বাসার অটিস্টিক ছেলেটি- যে আমাকে ভালোবাসে। আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি কি ভেবে রেখেছি জানেন?

-কি?

-ভেবে রেখেছি সে যদি আর কোনাদিন আমার জীবনে না-ই আসে তবে আমি পাশের বাসার ঐ অটিস্টিক ছেলেটিকেই বিয়ে করব। নিজেকে শাস্তি দেয়ার জন্য। নিজের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য।

-এত ভেঙে পড়ার কি আছে? সে তো এখনও ফিরে আসতে পারে।

-আমার কথা শুনে হয়ত আমাকে ভীষণ কল্পনাবিলাসী মনে হচ্ছে। তাই না? কিন্তু আমি কল্পনায় যেমন তার ফিরে আসার কথা ভাবি তেমনি বাস্তবে এও জানি যে সে আর কোনদিনই ফিরে আসবে না।

-এমন ভাবার কারণ কি?

-কোন কারণ নেই। যেটা সত্য সেটা মেনে নেওয়াটা ই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?

-কিন্তু আমি যদি তাকে ফিরিয়ে এনে দিই।

-গল্পে?

-না বাস্তবে। তোমার দরজার সামনে।

-আপনি আমার দুর্বলতার সুযোগে যথেষ্ট মজা করছেন। এবার থামান প্লিজ।

-কিন্তু আমি যদি সত্যিই তাকে এনে দিতে পারি।

-মানে?

-মানে, তুমি জেমীমা জামান জয়া না?

-হ্যাঁ।

-তুমি জে সি দত্ত কলেজে পড়তে।

-হ্যাঁ। আপনি কি করে জানলেন।

-কারণ, আমিই সেই রায়হান আহমেদ রবিন- আজ সবার পরিচিত লেখক রবিন রায়হান।

-কি বলছেন আপনি?

-যা বলছি সত্যি বলছি।

-তা আপনি মানে তুমি এখন কোথায়?

-এই তো এই শহরেই আছি।

-তা এতদিন কোথায় ছিলে?

-সে অনেক কথা। পরে বলবো।

-আচ্ছা ফোনে নয় তোমার সামনে এসে তোমার মুখ থেকেই সব শুনবো। তুমি এখন কোথায় আছো বলো। আমি এখনই তোমার কাছে চলে আসবো।

-তোমাকে আসতে হবে না। আমি নিজেই কাল সকালে তোমার দরজায় হাজির হবো।

-কাল সকালে কেন? এখনই আসো না। এখন তো আর বাবা মায়ের ভয় নেই। আমরা দু’জনেই এখন ম্যাচিউরড। আর ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আমি এখন এ শহরের একজন নামকরা তরুণ ডাক্তার। সুতরাং কোন সমস্যা নেই। তুমি এখনই চলে আসো। আজ বাইরে কি চমৎকার জোছনা। এই চাঁদের আলোয় ছাদের পরে আমি বসে থাকবো। আর তুমি আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে আমাকে গল্পের ভাষায় তোমার এতদিনের জীবনের কাহিনি শোনাবে। আর আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দেবো। একবার ভাবো তো ব্যাপারটা কেমন হবে?

-জয়া, আমাদের সামনে তো আরও অনেক জোছনা রাত পড়ে আছে। তার চেয়ে আমি কাল সকালেই আসি।

-কেন?

-তোমার প্রার্থনাকে সত্যি করতে। 

-তুমি অনেক বদলে গেছো।

-কিভাবে বুঝলে! তুমি তো কাছে থেকে কখনও আমায় উপলব্ধি করো নি।

-এতটা দিন যে কল্পনায় তোমাকে জড়িয়ে ছিলাম তার পুরোটা ই কি মিথ্যা?

-জানি না।

-আমিও না। বলেই জয়া খিল খিল করে হেসে উঠে। জয়ার হাসি রায়হানের বুকের বরফ গলিয়ে দেয়। বুকের ভেতর তরল নদী বইতে শুরু করে। তার সামনে ভেসে উঠে- অবারিত মাঠ-সবুজ সবুজ। অদ্ভুত সোনালি আলো। সে সেই আলোতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।




Comments: