অনাকাঙ্খিত আকাঙ্খা

অনাকাঙ্খিত আকাঙ্খা

সোহেল মাহরুফ


শহরে বেশ বড় রকমের হৈ চৈ পড়ে গেছে। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে তো বটেই জাতীয় পত্রিকাগুলোতেও ব্যাপারটা বেশ কভারেজ পাচ্ছে। আর ব্যাপারটা হচ্ছে সাড়া জাগানো রকস্টার বাপ্পী তার নিজ শহরে আসছেন। প্রায় পঁচিশ বছর পর। পুরো শহর জুড়ে তোলপাড়। আর এই ঝড়ের ঝাপটা এসে জেসমিন আর তার মেয়ের ছোট্ট নীড়েও লেগেছে।


স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর ছোট্ট লিজাকে নিয়েই জেসমিন তার টিকে থাকার সংগ্রাম শুরু করেছিল। কঠোর পরিশ্রম আর অপরিসীম স্নেহে মেয়েকে সে বড় করে তুলেছে। আজ লিজা কলেজে পড়ে। অতি আদরে ছেলেমেয়ের যা হয় লিজার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। তার উচ্ছলতা প্রায়ই সীমা লঙ্ঘন করে। তবু এতদিন লিজাকে নিয়ে জেসমিনের কোন ভয় হয়নি। মনে হয়েছে লিজা এখনও তার স্নেহের বাঁধনে বাঁধা আছে। কিন্তু রকস্টার বাপ্পীকে ঘিরে লিজার বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহটা তার ভালো ঠেকছে না। আগে থেকেই বাপ্পীর প্রতি লিজার বাড়াবাড়ি রকমের উচ্ছ্বাস ছিল। তার প্রতিটি অ্যালবামের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো। তার বিশাল বিশাল পোস্টারে লিজার পুরো রুম ভরে আছে। কোথা থেকে যেন বাপ্পীর ফোন নম্বরও জোগাড় করেছে। জেসমিন এতদিন এটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে। তার কাছে এটা ঠিক টিনএজের উন্মাদনা বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু এই কয়েকদিনের লিজার উন্মাদনা তার কাছে বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছে। নাওয়া নেই- খাওয়া নেই, কলেজ-পড়াশোনা কিচ্ছু নেই। সারাদিন কোথায় কোথায় ছুটে বেড়াচ্ছে তথ্য সংগ্রহের জন্য। অর্থাৎ বাপ্পী সাহেব কোন রেস্ট হাউসে উঠবেন, কোথায় কোথায় কনসার্ট করবেন, কোন রেস্তোরাঁয় খাবেন, কোন ফ্লাইটে আসবেন, কখন এসে পৌছবেন, কখন লিভ করবেন- এসব তথ্য সংগ্রহের জন্য। মনে হয় যেন সে বাপ্পী সাহেবের প্রোটোকল অফিসার। এ সবকিছুই জেসমিনের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। এসব নিয়েই তার খুব টেনশন হচ্ছে। এ কয়েকদিনে তার কপালের রেখা অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাতে ঠিকমত ঘুম হচ্ছে না। চোখের কোণে কালি জমে গেছে। আজ অফিস বন্ধ। সারাদিন বাসায়। এদিকে লিজাটা যথারীতি ব্যস্ত বাপ্পীর আগমন উপলক্ষে। তাই আজ ভাবনাগুলো যেন জেসমিনের মাথায় জেঁকে বসেছে। ভাবতেই জেসমিন হঠাৎ লিজার রুমে ঢুকে পড়ে। তার রুম যথারীতি অগোছালো। আর দেয়াল জুড়ে বাপ্পীর বিশাল বিশাল পোস্টার। জেসমিন এগুলো এতদিনও দেখেছে। কিন্তু কখনও সেভাবে খেয়াল করেনি। আজ মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই সে একটা বিশাল ধাক্কা খায়। আবার তাকায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারপরও নিশ্চিত হতে পারে না। মনে হয় কোথায় যেন তাকে দেখেছে। খুব চেনা একজন। কিন্তু তারপরও বিশ্বাস হচ্ছে না। 

এর মধ্যে লিজা কোথা থেকে যেন এসে হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে। মাকে দেখেই আনন্দে জড়িয়ে ধরে- মা জানো আমি না পুরো শিডিউলটা ই জোগাড় করতে পেরেছি। কালই তিনি আসছেন। তার সাথে আমার আজ সকালেও ফোনে কথা হয়েছে। তিনি কি বলেছেন জানো? বলেছেন তিনি যদি সময় পান তবে আমাদের বাসায়ও আসবেন।

জেসমিন মেয়েকে আর প্রশ্রয় দিতে চান না। বলেন- লিজা তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো। 

-মা তুমি একবার ভাবো তার মত বিখ্যাত লোক যদি একবার আমাদের বাড়িতে আসে তবে ব্যাপারটা কেমন হবে।

-তারপরও। এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।

-মা তুমি এসব কি বলছো! সে কত ট্যালেন্টেড একটা লোক তুমি তা জানো? তার মতো লোক আমাদের বাড়িতে আসা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। মা তুমিতো তার গান কখনও শুনোনি। শুনলে বুঝবে যে সে কি? দাঁড়াও, এক্ষুনি শোনাচ্ছি। বলেই সে ছুটে গিয়ে সি ডি প্লেয়ার ছেড়ে দেয়। এক মায়াবী কন্ঠ বেজে উঠে। জেসমিন আবার ধাক্কা খায়। এ যে তার পরিচিত কন্ঠ। এ কন্ঠ সে কতদিন শুনেছে। ক্যাসেটে নয়- বাস্তবে। সে আর কিছু বলে না। নীরবে উঠে দাঁড়ায়। রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু ভাবনা তাকে ছাড়ে না। সারাদিন ভাবে। সারারাত ভাবে। একটুও ঘুমুতে পারে না। একদিনেই তার চেহারা খারাপ হয়ে যায়।


সকালে বিছানা ছেড়ে দেখে লিজা হাওয়া। সে আবার অস্থির হয়ে উঠে। কিন্তু কিছু করার থাকে না। শুধু অকারণে ছটফট করা ছাড়া। মাঝে মাঝে অন্য ভাবনাও মাথায় আসে। সে অস্থির হয়ে উঠে। মাঝে একবার কি মনে করে হঠাৎ লিজার রুমে ঢুকে। দেয়ালের ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। কী যেন বের করতে চেষ্টা করে। হঠাৎ কি যেন পেয়েও যায়। সারাদিন রিমোট হাতে টিভির সামনে বসে থাকে। ঘুরে ফিরে একই নিউজ। বাপ্পীর কভারেজ। বোঝা যাচ্ছে বাপ্পী জ্বরে বেশ ভালো ভাবেই এ শহর কাঁপছে। তার সারাদিন এভাবেই কাটে। রাত আটটার দিকে মায়ের দুশ্চিন্তাকে আর দীর্ঘায়িত না করে লিজা বাসায় ঢোকে। মায়ের চেহারা দেখে সে কিছুটা ভয় পায়। তবু অপর পক্ষ থেকে সেরকম কোন কিছু না দেখে সে উৎসাহিত হয়। উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে- জানো মা, আজ তার সাথে ফেইস টু ফেইস মিট করেছি। কাছে থেকে কথা বলেছি। মা সে অমায়িক লোক। স্টার হয়ে গেলে কতজনে কত ভাব ধরে। কিন্তু তার ভেতরে সেরকম কিছুই নেই। সে খুব সাধারণ- ছিমছাম। তাকে সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞেস করল- আপনি এত বিখ্যাত হয়েও এত সাধারণ লাইফ কীভাবে লিড করেন। তখন তিনি কি বললেন জানো? বললেন- আমি আসলেই সাধারণ। আর আপনারা আমার যা কিছু অসাধারাণ বলছেন তার সবটুকুর কৃতিত্বই এক নারীর। আমি সে নারীর কাছে কৃতজ্ঞ। তখন তো সাংবাদিকরা তাকে চেপে ধরলেন সেই মহিলার সম্বন্ধে বলার জন্য। কিন্তু সে এ সম্পর্কে কিছুতেই আর কিছু বলেনি।

এতদূর পর্যন্ত লিজা এক নিঃশ্বাসেই বলে ফেলে। তারপর একটু দম নেয়। তারপর আবার শুরু করে-জানো মা, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার নাম বলার সাথে সাথেই সে আমাকে চিনে ফেলে। আমাকে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ দিতে ও রাজী হয়েছে। কাল দুপুরের পরে উনি আমাকে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ দিতে রাজী হয়েছেন। বলেছেন তখন তিনি ফ্রি থাকবেন- তখন আমাকে তার রেস্টহাউসে যেতে বলেছেন।

এ কথা শুনে জেসমিন হঠাৎ মেয়েকে অবাক করে দিয়ে বলে- আমিও তোর সাথে যাব। আমাকে নিয়ে যাবি?

এ কথা শুনে লিজা একটু অবাক হলেও পরক্ষনেই মাকে জড়িয়ে ধরে বলে- মা, মাই স্মার্ট মা। আমি তোমাকে অবশ্যই নিয়ে যাব।


এরপর আরো টুকিটাকি কথা চলে। নিত্যদিনের মতো। দু’জনে মিলে ঠিক করে কে কোন ড্রেস পরে যাবে। তারপর দু’জনেই দু’জনের বিছানায় যায়। বিছানায় যেতেই জেসমিনের মাথায় চিন্তাটা চেপে বসে। ভাবে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? আজ এতদিন পরে। সত্যিই যদি সে হয়। তাহলে মেয়ের সামনে সে কীভাবে সামলাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই তার ঘুম উধাও। ভাবে যাবে না। তবু আবার ভাবে একবার তার মুখোমুখি হওয়া দরকার। এভাবেই দ্বিধা দ্বন্ধে সারাটা রাত কাটে। সকাল বেলাটাও কেটে যায়। অবশেষে সব দ্বন্ধ ঝেড়ে ফেলে সে প্রস্তুত হয়। মেয়েকে নিয়ে বের হয়- ঘড়ি ধরে জাস্ট সময়ে। 

ঘরে ঢুকতেই লিজা দেখে বাপ্পী বসে আছে। সহাস্যে বলে উঠে- তোমার অপেক্ষাতেই। বস।

-আমার সাথে আরো একজন আছেন। বলতেই পর্দার আড়াল থেকে জেসমিন বেরিয়ে আসে। সে যা ধারণা করেছিলো তাই- ই ঘটে গেছে। তাই সে খুব একটা অপ্রস্তুত হয় না। কিন্তু বাপ্পী অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। লিজা পরিচয় করিয়ে দেয়- ইনি আমার...

লিজার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বাপ্পী বলে- তোমার মা।

লিজা অবাক হয়ে যায়। তার বিস্ময় কাটাতেই বাপ্পী বলে- তোমার চোখ দু’টো ঠিক তোমার মায়ের মতো।

-ওহ্ তাই!

-বসো। তিনজনেই বসে। পোশাকি কথাবার্তা চলে। কিন্তু জমে না। কোথায় যেন কাটা পড়ে। কিছুক্ষণ এভাবে চলে। তারপর হঠাৎ বাপ্পী বলে উঠে- লিজা, তুমি কি একটু পাশের রুমে যাবে। আমি তোমার আম্মার সাথে একটু কথা বলি। লিজা কি বোঝে বোঝা যায় না। হেসে বলে- জ্বি আচ্ছা। লিজা রুম ছাড়তেই বাপ্পী বলে উঠে- তুমি!

-এখনও আমাকে মনে রেখেছ!

বিষন্ন হাসি হেসে বাপ্পী বলে- তোমাকে কি ভোলা যায়! জানো, আজকে যে প্রশ্নটার উত্তর জানার জন্য লিজাকে দেখা করতে বলেছি সে প্রশ্নের উত্তর সে সাথে করে নিয়েই চলে এসেছে।

-মানে?

-আসলে সে যেদিন প্রথম আমাকে ফোন করেছিলো সেদিন আমি ঘোরের ভেতরে চলে গিয়েছিলাম। অবিকল তোমার কন্ঠ। আমার মনে হয়েছিলো তুমিই বোধ হয় ফোনে কথা বলছো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি শুধু তার কন্ঠেরই প্রেমে পড়ে গেছি। তারপর কাল যখন তাকে দেখলাম তখন তো আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। দেখি তার চোখ অবিকল তোমার মতো। তখন আমি সিউর হলাম যে তোমার সাথে তার কোন রিলেশন আছে। তাই তাকে দেখা করতে বলেছি। 

-আসলে ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি তো তাই সবকিছুই আমার মতো হয়েছে।

-তা কেমন আছ?

-হ্যাঁ ভালই। ভালই চলছে মা মেয়ের সংসার। 

-মানে? মেয়ের বাবা কোথায়?

-বাপ্পী, জীবনটা আসলেই বড় অদ্ভুত। জীবনে কিছু বুঝে উঠার আগেই অনেক কিছু পেয়েছি। আবার কিছু বুঝে উঠার আগেই সব হারিয়েছি।

-মানে?

-না মানে আঠারোতে বিয়ে, বিশে মেয়ের মা আর তেইশে ডিভোর্স। তারপর থেকে একা একা পথ চলা। শুরু হলো সংগ্রাম। বেঁচে থাকার সংগ্রাম, মেয়েকে মানুষ করার সংগ্রাম, ইত্যাদি। অবশেষে সবকিছু সামলিয়ে এখন আমি সফল নারী উদ্যোক্তা, সমাজে একটা দৃষ্টান্ত। এর মাঝখানে কত না বলা দুঃখ, যন্ত্রণা, বঞ্চনা। আসলে তোমরা শিল্পীরাই ভালো আছো। কোনো দুঃখ, কোনো কষ্ট তোমাদের স্পর্শ করে না।

-ঠিকই বলেছো। এই যে এতটা পথ একা একা এলাম কখনও সেরকম কিছু মনে হয়নি। শুধু মাঝে মাঝে তোমার কথা মনে পড়ত। তখন গিটার নিয়ে বসে যেতাম। সুরের ভুবনে হারিয়ে যেতাম। আর এভাবেই তো আমার সব সুরের সৃষ্টি।

-তা একা একা মানে? এখনও বিয়ে করোনি?

-জেসমিন, তোমার পাশে আর কাউকে ভাবতে পারিনি।

-কি অদ্ভুত! জানো আমার এই দুর্গম পথ চলতে চলতে শুধু তোমার কথাই মনে পড়ত। মনে হতো তোমাকে ছেড়ে এসে আমি ভুলই করেছি। যদিও সেদিন ভেবেছিলাম তোমার মত ছন্নছাড়ার সাথে নিজেকে জড়িয়ে জীবনটাকেই নষ্ট করব। তাই বাবা মায়ের পছন্দেই এক শিল্পপতিকে বিয়ে করেছিলাম। তারপর তো যা হবার তাই হল। আসলে সবই নিয়তি।

-আসলেই সব নিয়তি। নইলে আমিই বা কেন বাবার এতবড় ইন্ডাস্ট্রি, গাড়ি, বাড়ি সবকিছুর মায়া ছেড়ে এই ছন্নছাড়া জীবন বেছে নেব। যাক, তবু এই দেখে ভালো লাগছে যে তুমিও আজ প্রতিষ্ঠিত, সুখী একজন মানুষ। সেদিন তো তোমার সুখের কথা ভেবেই আমি সব মেনে নিয়েছি। 

-কিন্তু এই কি সব?

-মানে?

-বাপ্পী, আমরা কি আবার আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারি না?

-যাও! কি বলছ এসব!

-সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো সিরিয়াসলি বলছি। কতদিন চরম যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ভেবেছি তুমি যদি ফিরে আসতে তবে তোমার হাত ধরে সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতাম।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাপ্পী বলে- জেসমিন, তুমিও এখন আর সেই ষোল বছরের কিশোরী কিংবা আমিও সেই আঠারো বছরের ছেলেটি নেই। তোমাকে মনে রাখতে হবে তুমি এখন বিশ বছর বয়সী এক কন্যার মা।


একথা শুনে জেসমিন চুপ হয়ে যায়। বাপ্পীও বলার মতো আর কিছু খুঁজে পায় না। দু’জনেই মুখোমুখি বসে থাকে। বিকেলের আলো নিভে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। পর্দা ঠেলে লিজা রুমে ঢোকে। কিন্তু কিছুই বলে না। তার ভারী মুখ দেখে তারা দু’জনেই সম্বিৎ ফিরে পায়। লিজা একসময় মায়ের হাত ধরে বলে- মা বাসায় চল।




Comments: